রিপন মিয়া-
বাবার বাড়ীতে যে মেয়েটাকে সেহরী খাওয়ার জন্য সজাগ করতে মিনিটে মিনিটে ডাকতে হতো, সেই মেয়েটা স্বামীর বাড়ীতে সবার আগে উঠে সেহরীর প্রস্তুতি করতে হয়।
এটাই বাস্তব জীবন! প্রতিটি মেয়েই নিজ বাবার ঘরে যেনো এক রাজকন্যা। কিন্তু বিয়ের পর আমাদের সমাজে অনেক মেয়েকে নানা ভাবে বিভিন্ন কারণে নির্যাতিত হতে হয়।
বিশেষ করে আমাদের সমাজে একটি প্রাচীন কুসংস্কার চালু রয়েছে – সেটি হলো রমজান মাসের ইফতারি প্রথা। আমাদের সমাজের ৯৫% ফ্যামিলিতে এমন আছে যে, ছেলে নতুন বিয়ে করলে প্রথম রমজানে ছেলের ফ্যামিলিকে মেয়ের বাবার পক্ষথেকে ইফতার করাতে হবে।
আবার নাকি রমজানের মধ্যভাগে ছেলের বাড়ীর চৌদ্দ গোষ্ঠিকে ইফতারি করাতে হবে। দেরি করা যাবে না। রমজানের শেষের দিকে ইফতারি দেয়া হলে আবার নাকি এলাকায় বদনাম হওয়ারও ভয় থাকে। কমও আনা যাবে না। পুরো গ্রামে বন্টন করতে হবে বিধায় যথেষ্ট পরিমাণে আনতে হবে – ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ছেলের বউ ও তার বাবার বাড়ির লোকজনদের প্রচন্ড মানষিক চাপে রাখা হয়।
বর্তমান সভ্য সমাজে এই অনৈতিক কাজে ডুবে থাকা আমাদের মোটেও উচিত নয়। এভাবে আর চলতে দেয়া যায়না। তাই এই প্রাচীনতম এবং চরম ঘৃণিত কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসা এখন সময়ের দাবি। বিশেষ করে কোভিড-১৯ এর এই দূর্বিসহ পরিস্থিতিতে আমাদের সবাইকে মানবিকতা ও উদারতার পরিচয় দিতে হবে।
এখন আসুন, যে রমজান মাসে আমরা এই প্রথা চালু করেছি, সেই মাস আমাদেরকে কি শিক্ষা দেয়, সংক্ষেপে জানার চেষ্টা করি….
ভোর (সুবহে সাদিক) থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে পানাহার, জৈবিক চাহিদা থেকে বিরত থাকার নামই সিয়াম।
গোলামের এই উপবাস থাকাটা কি মহান রবের খুব বেশী প্রয়োজন ছিলো?
আসলে মহান আল্লাহ তা’আলা তার বান্দাকে দুনিয়ার জীবনে উপবাসের কষ্ট উপলব্ধি করে মানবিক হওয়ার শিক্ষা নিতে রোজা ফরজ করেছেন। যেমন করেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষের উপরও। এতে করে তাক্বওয়া অর্জন করার সুযাগও রয়েছে।
ইসলামিক রীতিনীতি অনুসারে নিকট আত্মীয় পাড়া প্রতিবেশীর হক্ব সম্পর্কে সবার মোটামোটি ধারণা আছে। রমজান মাসে এর চর্চা খুব বেশি হয়। তাই আমি মনে করি, রোজা বা সিয়ামের সাথে সাম্যের সম্পর্ক অবশ্যই বিদ্যমান।
প্রতি বছরেই রমজান মাস আসে, আমরা সিয়াম পালন করি। কিন্তু সেই মাসের প্রকৃত শিক্ষা কি আমরা ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে প্রয়োগ করি? যদি করে থাকি তাহলে কেন এই অনৈতিক কাজ কে দীর্ঘদিন থেকে সাপোর্ট করে আসছি?
একটি মেয়ের জন্ম থেকে শুরু করে তার বিয়ে পর্যন্ত বাবার জন্য কি পরিমাণ পেরেশানীর বিষয় – তা শুধু মেয়ের বাবারাই ভালো বুঝবেন। এবিষয়ে অর্থনৈতিক দিক লিখতে গেলে আজ আর শেষ করতে পারব না।
ইফতারি প্রথা যদি উচ্চ বিত্তদের বিলাসিতা হয় তবে সেটা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। এখনই আমাদের এই ইফতারি প্রথাকে সামাজিক ভাবে বয়কট করতে হবে। মেয়ের বাড়ী ইফতারি দেওয়ার জন্য শুধু নিম্নবিত্ত নয়, মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির বাবা মা এবং বড় ভাইদের কি পরিমান অর্থনৈতিক দুর্ভোগ পোহাতে হয়, এই সমাজ তা এখনও উপলদ্ধি করতে ব্যর্থ।
পক্ষান্তরে, যে মেয়ে এই পরিস্থিতির শিকার হয়ে এক অভাবনীয় মানষিক চাপ এবং অসহায়ত্ত্বের কারণে সেই সংসারে যে কলহ সৃষ্টি হয়, তার দায়-ও আমাদের সমাজ এড়াতে পারে না। এ থেকে বের হয়ে আসতে হলে, সামাজিক সচেতনতার বিকল্প নেই।
তাই আমার ছোট্ট একটি সাজেশন-
বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকায় একটি বিষয় ইদানীং খুবই লক্ষনীয়। বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডে যুবকরাই বেশি এগিয়ে। এই ইফতারি প্রথাকে সমাজ থেকে প্রতিহত করতে হলে নিজ নিজ এলাকায় যুবকদের এগিয়ে আসতে হবে।
সংঘবদ্ধ ভাবে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। রমজান মাসের শুরু থেকে আপনাদের নিজ নিজ এলাকায় যৌতুক প্রথার মত “ইফতারিকে না বলতে হবে” এই ভাবে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হয়তো সমাজ থেকে এই কুসংস্কার একদিন বিলীন হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।