সত্যজিৎ দাস(স্টাফ রিপোর্টার):
ভূত চতুর্দশী একটি বাঙালি হিন্দু উৎসব। হিন্দু শকাব্দ অনুসারে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীর দিন।অর্থাৎ দীপান্বিতা কালীপূজার আগের দিন ভূত চতুর্দশী পালন করা হয়।এই একই দিনে উত্তর ভারতে নরক চতুর্দশী বলে অপর একটি হিন্দু উৎসবও পালিত হয়।এই দিন বাঙ্গালী গৃহস্থের বাড়িতে চৌদ্দটি প্রদীপ জ্বালানো,চৌদ্দ রকম শাক একত্রে রান্না করে অন্নের সাথে খাওয়া ও এ দিন ছেলেদের কপালের ডানে আর মেয়েদের কপালের বায়ে ঘি-তুলসীপাতা-কাজল ধারণের প্রথা রয়েছে।পশ্চিমী হ্যালোইন অনেকটা এর মত।
দৈত্যরাজ বলি স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল দখল করলে অসুররা সবার উপর অত্যাচার শুরু করে । বলিকে থামানোর জন্য ভগবান বিষ্ণু বামন অবতারে বলির কাছে তিন পা জমি চাইলেন । দৈত্যরাজ এতে রাজি হলেন । বামন অবতার দুই পা স্বর্গ ও মর্ত্যে দিলেন । এরপর নাভি থেকে বের হওয়া তৃতীয় পা বলির মাথায় দিয়ে তাকে পাতালে পাঠিয়ে দিলেন । নিজের কথা রাখায় ও তাকে চিনেও দান দেয়ায় বামন অবতার বলিকে প্রতি বছর পৃথিবীতে পূজা পাওয়ার আশীর্বাদ করলেন । এরপর থেকে কালীপূজার আগের রাতে রাজা বলি পাতাল থেকে পৃথিবীতে পূজা নিতে আসেন। তার সাথে সহস্র ভূত, প্রেতাত্মা এবং অশরীরী এ সময় আসে। অন্য মতে চামুণ্ডা রূপে মা কালী এ দিন চৌদ্দখানা ভূতকে সাথে নিয়ে ভক্তের বাড়ি থেকে অশুভ শক্তিকে দূর করতে পৃথিবীতে আসেন।
হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস হয় মৃত পূর্ব পুরুষরা আশ্বিন মাসের কৃষ্ণ চতুর্দশীর দিন মর্ত্যে আসেন৷ তাদের আনন্দে রাখতে এবং অতৃপ্ত আত্মার অভিশাপ দূর করতে তাদের পূজা করা হয়। প্রথা অনুযায়ী চোদ্দ শাক খাওয়া হয় এবং চোদ্দ প্রদীপ জ্বালানো হয়। হিন্দু ধর্ম মতে মৃত্যুর মানব দেহ পঞ্চভূতে (ক্ষিতি-অপ-তেজ-মরুৎ-ব্যোম) বিলীন হয়ে পাঁচ উপাদানের মধ্যেই মিশে থাকেন। তাই প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা ১৪ রকমের শাক মৃত ১৪ পুরুষের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। ১৪ শাক ধোয়ার পর সেই বাড়ির প্রতিটি কোনে ছিটিয়ে দেওয়া হয় এবং প্রেত ও অশুভ শক্তি দূর করতে বাঙালি গৃহস্থরা এই দিন সন্ধেয় বাড়িতে চোদ্দ প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকেন।
ধনতেরস দিয়ে শুরু হয় পাঁচ দিনের দীপাবলি উৎসব। আজই ধনতেরস। এরপর নরক চতুর্দশী। তারপর কালীপুজো। তারপর একদিনের ব্যবধানে ভাইফোঁটা।
ধনলক্ষ্মীর আরাধনা দিয়ে শুরু হয় উৎসব। কার্তিক মাসের ত্রয়োদশী। এই তিথিতে হয় ধনতেরস উৎসব। ধনদেবীর আরাধনার এক বিশেষ দিন। দীর্ঘদিন ধরে উত্তর ভারতেই এর চল থাকলেও এখন বাংলাতেও বেশ জনপ্রিয় ধনতেরস। সোনা-রুপোর গয়না কিনতে ওই দিন ভিড় জমান মানুষ।
পরের দিনটিই ‘ভূত চতুর্দশী’। গুজরাত, রাজস্থানে ‘রূপ চৌদাস’ নামে পালিত হয় উৎসব। দক্ষিণ ভারতেও এই উৎসব উদযাপন হয়। বাঙালিরা এইদিন বাড়িতে ১৪ টি প্রদীপ জ্বালায়। ১৪ পুরুষের জন্য আলো জ্বালায় দারে দারে । বাড়ির প্রতিটি দরজায় জ্বালানো হয় বাতি। কৃষ্ণপক্ষের ১৪ তম দিন অর্থাৎ অমাবস্যার আগের দিন চতুর্দশী। সেই সঙ্গে খাওয়া হয় চোদ্দ শাক।
আবার, কারও কারও বিশ্বাস, আমাদের পূর্বপুরুষেরা ওই দিন পরলোক থেকে ইহলোকে নেমে আসেন। তাঁরা দেখতে আসেন, তাঁদের ছেড়ে যাওয়া পরিবার, বাড়ি, দোর দালান। তাঁদের দিশা দিতেই ও আলো দেখিয়ে ফিরিয়ে দিতেই ১৪ প্রদীপ জ্বালার প্রথা। অনেক বাড়িতে আবার পরলোকগত পূর্বপুরুষের মিষ্টি-জল নিবেদন করা হয়।
বাঙালি পরিবারে বিশ্বাস, ১৪ রকম শাক সহযোগে ভাত খেলে ভূত-প্রেত দূরে থাকে। কেউ কেউ আবার এইদিনটিকে ছোটি দিওয়ালি হিসেবেও পালন করে। চোদ্দ শাকের মধ্যে থাকে আমরুথ পাতা , বেতো শাক, সর্ষে শাক, কাসুন্দে পাতা, পলতা পাতা, শালুক পাতা, প্রভৃতি। চোদ্দ প্রদীপের আলো যেন সারা রাত না নিভে যায়, খেয়াল রাখতে হবে। সারা রাত ঘর দোয়ার আলোকমালায় সাজিয়ে রাখতে হবে।
দীপাবলিতেই রামচন্দ্র ১৪ বছরের বনবাস কাটিয়ে অযোধ্যায় ফিরে এসেছিলেন, বলে বিশ্বাস। অযোধ্যায় রামচন্দ্রকে স্বাগত জানাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে অযোধ্যা নগরীকে সাজানো হয়। সেই থেকে এই প্রথা মানা হয়ে আসছে বলেই অনেকের বিশ্বাস।