সত্যজিৎ দাস(স্টাফ রিপোর্টার):
আজকের দিনে যে ভালোবাসা দিবস দেখছেন আপনারা,আসলে এটা তার মূল ধারায় এমন ছিলোনা। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে এই সমৃদ্ধ উৎসবে এসেছে ভিন্নতা। ভ্যালেন্টাইনস ডে অথবা সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে নামের মধ্যেই রয়েছে বিশাল এক রক্তাক্ত ইতিহাস। ১৪ই ফেব্রুয়ারির ভ্যালেন্টাইনস ডে’র সাথে জড়িত আছে অনেক জীবনদানকারীর নাম। প্রতিটিই একেকটি মিথের মতো। কিন্তু সবচেয়ে খৃস্টীয় তৃতীয় শতাব্দীর অতীতে থেকে আমরা যেটি জানতে পারি তা হলো রোমের সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের কথা। যিনি কিনা একজন পুরোহিত ছিলেন। রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্যালুডিয়াসের সময় তিনি তার সৈনিকদের মধ্যে বিবাহ বন্ধ করে দেন যাতে তার সৈনিকরা বেশি শক্তিশালী ও যুদ্ধোন্মাদ হয়। কিন্তু এই অনৈতিক নিয়মকে পুরোহিত সেইন্ট মেনে নিতে পারেননি। ফলে তিনি গোপনে অনেক রোমান সৈন্যদের বিবাহ পড়াতেন যাদের কিনা বিবাহ করা নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু সম্রাট একসময় এ কথা জেনে যান এবং ক্ষিপ্ত হয়ে সেইন্টকে বন্দী করেন। বন্দী আবস্থায় তিনি কারারক্ষী মেয়ে অস্টারিয়াসকে জীবনের অন্তিম বিদায়ক্ষণে চিঠিতে লেখেন “From Your Valentine” এখান থেকেই সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের সাহসিকতার গল্প চারদিকে ছড়িয়ে যায় এবং পরবর্তীতে খৃস্টান ক্যাথলিক চার্চ কর্তৃক ধর্মীয় উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি পায়।আরেক মিথ থেকে জানা যায় যে,সেইন্ট ভ্যালেন্টাইন মূলত খৃস্টান কঠিন রীতি থেকে অনেককে বের করার জন্য প্রচেষ্টা চালায়। যার ফলে তাকে হত্যা করা হয়।
অনেকেই মনে করে থাকেন যে,ভ্যালেন্টাইনস-ডে ফ্রেবুয়ারির মাঝামাঝিতে সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুবার্ষিকী হিসেবে পালন করা হয়ে থাকতো। যা কিনা ২৭০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে শুরু হয়। আবার অরেক দল মনে করে যে,ক্যাথলিক চার্চ রোমের কৃষি উৎসব “লুপারসালিয়া”কে খ্রিষ্টীয় ধারা করার জন্য ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে করা হয়। লুপারসালিয়া মূলত রোমের জমির উর্বরতার উৎসব বা পূজা হিসেবে পালিত হত। এই উৎসবকে মূলত উৎসর্গ করা হতো কৃষির দেবতা ‘ফাউনাসের’ প্রতি। সাধারণ মানুষ পবিত্রতা লাভের জন্য কুকুর,শুয়র এমনকি নারীও নাকি বলি করতো। আবার আরেক মিথ থেকে জানা যায় যে,তৎকালীন রোমের মেয়েরা একটি স্থানে একত্রিত হত এবং তাদের নাম লিখে জমা দিত। শহরের অবিবাহিত ছেলেরা এসে সেখান থেকে লটারির মাধ্যমে একেকজন মেয়েকে এক বছরের জন্য গ্রহণ করতো। অনেকসময় এই এক বছর থেকে বিবাহ পর্যন্তও গড়াত। কিন্তু এখানে কোন নিশ্চিত তথ্য প্রামাণিক উৎস নেই যে,কৃষি উৎসবের সাথে রোমান্টিকতার কোন মিল আছে। একাধিক ঐতিহাসিকও এই ব্যাপারে মত দিয়েছেন। তবে চতুর্দশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের জাতীয় কবি চশারের “ভ্যালেন্টাইন” সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে এর যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। এর আগে ভ্যালেন্টাইন-ডে কে রোমান্টিকতার সাথে সম্পৃক্ত থাকার ব্যাপারে কোন নিদর্শন পাওয়া যায়না। আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে ভ্যালেন্টাইনস-ডে কে রোমান্টিকতার নিদর্শন না ভেবে ত্যাগের নিদর্শন হিসেবেই দেখা যায়।
ভ্যালেন্টাইনস-ডে নিয়ে দুটি বিখ্যাত সাহিত্যিক গল্প রয়েছে। প্রথমটি হল ১৩৮২ সালে প্রকাশিত চশারের “পার্লামেন্ট অব ফউলাস”; যেখানে তিনি লেখেন যে,” এটা হল সেইন্ট ভ্যালেন্টাইনস-ডে, যখন(যেদিন) প্রতিটি পুরুষ পাখি তার মেয়ে পাখি খুঁজতে আসে।” মূলত চশার এটিকে ইংল্যান্ড এর দ্বিতীয় রিচার্ড ও বোহেমিয়ার আনার মধ্যকার বিয়ে উপলক্ষ্যে লিখেছিলেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে ১৩৮১ সালে এই বিবাহ সম্পাদিত হয়। যা রোমান্টিকতার প্রতীক হিসেবেই ব্যবহার করা হয়।
আরেকটি সাহিত্যকর্মকে কেন্দ্র করে পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ভ্যালেন্টাইনস-ডে এর উৎপত্তি কিংবা জনপ্রিয়তার কারণ হিসেবে ধরা হয়। ১৪১৫ সালে চার্লস, যিনি কিনা অর্নলসের রাজকুমার ছিলেন। তিনি “এগিনতোনিয়া” যুদ্ধে হেরে লন্ডন টাওয়ারে বন্দী থাকা অবস্থায় তার প্রিয়তমাকে এক চিঠি লিখেছিলেন। এর পরবর্তীতে শেক্সপিয়র তার লেখনিতে ভ্যালেন্টাইনস-ডে কে জনপ্রিয় করে তোলেন।
মূলত অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ভ্যালেন্টাইনস-ডে তে উপহার দেয়া নেয়ার প্রচলনটা বেড়ে যায়।বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মেক্সিকো,কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াতে ব্যাপক আকারে এই উৎসব পালিত হয়ে থাকে। যাহোক আধুনিক যুগের অষ্টাদশ শতাব্দীতে ভ্যালেন্টাইনস-ডে তে সীমিত আকারে কার্ড আদান প্রদানও চলতো। কিন্তু ব্যবসায়ীকভাবে অতটা জনপ্রিয়তা পায়নি ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত। ইংল্যান্ডে এই কার্ড ছাপা বেশ জনপ্রিয় ও লাভজনক হয়ে উঠে। পেপার কাটিং ও সুন্দর রঙিন কাগজের আদলে বিভিন্ন ছন্দে যুক্তকরে হাতে লিখে তৈরি হত এসব ভ্যালেন্টাইন কার্ড। ইংল্যান্ড ডাক বিভাগের হিসাব মতে,শুধু ১৮৩৫ সালেই ভ্যালেন্টাইনস-ডে উপলক্ষ্যে বিলি হয় ৬০,০০০ হাজার চিঠি। ১৮৪০ সালে ডাক পরিবহণের মূল্য যখন বেশ কমে যায় তখন তা বছরে ৪,০০০০০ তে পৌঁছে যায়। যুক্তরাষ্ট্রেও ঠিক একই সময় ভ্যালেন্টাইনস ডে বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে।বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে হাতে লেখার বদলে প্রিন্ট করা কার্ড পাওয়া যেত খুব সস্তায়। আবার ডাক পরিবহণ খরচও কমে যায়। ফলে ভ্যালেন্টাইনস-ডের জনপ্রিয়তা আরো বেড়ে যায়। চকলেট গিফট ও গোলাপ গিফট করাও এর পাশে স্থান করে নেয় আস্তে আস্তে।যাহোক গ্রিটিং কার্ড এসোসিয়েশন এর মতে, বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় ১ বিলিয়ন কার্ড বিক্রি করা হয়ে থাকে এবং মোট কেনাকাটার ৮৫% নারীরাই এগিয়ে থাকেন। ভ্যালেন্টাইনস-ডে বর্তমানে ভালোবাসার চেয়ে কমার্শিয়ালইজেশনই বেশি হয়েছে।
পূর্ব অতীত ভ্যালেন্টাইন থেকে বর্তমানে পরিচালিত হয়েছে ভিন্ন গতিধারায়। এক কথায় জুটিদের জন্য এই ভ্যালেন্টাইনস ডে। কিন্তু যারা সিংগেল তাদের জন্য দিনটি বেশ হতাশারই বটে। তবে সিংগেলদের জন্য আরেকটি মজার তথ্য দিয়ে শেষ করা যাক। ১৪ ফেব্রুয়ারিতে আরেকটি উৎসবও বিশ্বব্যাপী পালিত হয়,তবে গোপনে। SAD(single awareness day) ;যারা সিংগেল তারাও উদযাপন করতে পারেন এই উৎসব। একা একা লাঞ্চ করতে পারেন কিংবা নিরিবিলি পরিবেশে ডিনারও সারতে পারেন। আবার ইচ্ছে করলে নিজের জন্যও দোকান থেকে দামি চকলেট কিনে আনতে পারেন। রোমের সিংগেলরাও কিন্তু এমন করতো!
১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ভালোবাসাকে কেন্দ্র করেই মানুষের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। ভালোবাসা হয়ে ওঠে সমস্ত সুখের উৎস ও বেঁচে থাকার প্রয়াস। তাই ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটি সব সম্পর্কের ও সব বয়সীদের মনে দিয়ে যায় দোলা।দিনটিতে প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধু-বান্ধব, স্বামী-স্ত্রী, মা-সন্তান, ছাত্র-শিক্ষকসহ বিভিন্ন বন্ধনে আবদ্ধ মানুষ একে অপরের প্রতি ফুল, চকোলেট, কার্ড ও অন্যান্য উপহার দিয়ে ভালোবাসা প্রকাশ করে থাকে।
এদিনে দেশের বিভিন্ন পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো ভালোবাসার মানুষদের দ্বারা পূর্ণ থাকে। ভ্যালেন্টাইন ডে বা ভালোবাসা দিবসের উৎপত্তির গল্পটি আমরা প্রায় সবাই জানি। তবে কিভাবে বিশ্ব থেকে এই ভালোবাসা দিবস এলো বাংলাদেশে? ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ হিসেবে পরিচিত ভালোবাসা দিবস বাংলাদেশে সূচনা করেন সাংবাদিক শফিক রেহমান। জানা যায়, তার তেজগাঁওয়ের পত্রিকা অফিসে কেউ চাকুরীর জন্য গেলে তাকে সাথে তার মেয়ে বন্ধুকে নিয়ে যেতে হতো। ভালোবাসা দিবস অভিধা প্রথম ব্যবহার করেন শফিক রেহমান। এ কারণে শফিক রেহমানকে বাংলাদেশে ভালবাসা দিবসের জনক বলা হয়। তিনি তার অফিসের সামনে সড়কটিরও নামকরণ করেন লাভলেন। বিভিন্ন টেলিভিশন ও প্রিন্ট মিডিয়ায় তার প্রচারণার কারণে এবং বাণিজ্যিক কারণে বাংলাদেশে এ দিবসটি জনপ্রিয় হয়।বাংলাদেশে ভালোবাসা দিবস হচ্ছে প্রতি বছর ১৪ ই ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে পালিত একটি দিবস। খৃষ্টীয় ৪৯৬ সাল থেকে এ দিবসটি সারা বিশ্বে পালিত হলেও বাংলাদেশে ১৯৮০ সালের পর থেকে এ দিবসটি জনপ্রিয় হয়। বাংলাদেশে এ দিবসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রকম শুভেচ্ছাসূচক কার্ড, ফুল, চকোলেট বা উপহারসামগ্রী বিনিময় করে বিশেষত তরুণ তরুণীরা।
লেখালেখির জন্য শফিক রেহমানকে ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত লন্ডনে নির্বাসিত থাকতে হয়েছিল। সে সময় তিনি সেখানে ‘ভালোবাসা দিবস’ উদ্যাপন হতে দেখেছেন। লন্ডনে নব্বইয়ের দশকে খুব বেশি উদ্যাপিত হওয়া শুরু হয় ভ্যালেন্টাইন ডে।
বাণিজ্যিক কারণে হলেও সেখানকার স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকারা দিবসটিকে সাদরে গ্রহণ করেন।ওই সময়ই শফিক রেহমান সিদ্ধান্ত নেন,বাংলাদেশে ফিরে আসার পর দিনটিকে বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেবেন। কারণ ভ্যালেন্টাইন ডের মধ্যে ভালোবাসার বাণী খুঁজে পেয়েছিলেন শফিক রেহমান। আর ঘন বসতির বাংলাদেশে ভালোবাসাটা অনেক বেশি দরকার। সুসম্পর্ক, সহাবস্থান গড়ে ওঠা জরুরি। তবে বাংলাদেশে শুরু করার আগে লন্ডনে প্রচলিত ‘সেন্ট ভ্যালেন্টাইনস ডে’ থেকে শুরুর ‘সেন্ট’ শব্দটি ধর্মীয় কারণে বাদ দেওয়া হয়। এটি ‘ভালোবাসার দিন’ হিসেবে প্রচার শুরু হয় তৎকালীন যায়যায়দিন পত্রিকায়। সেই সঙ্গে দিনটিকে শুধু স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ভাই-বোন, বাবা-মা-সন্তানদের মধ্যে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশও যুক্ত করা হয়। বলা হয়, ‘এই দিনে মায়ের প্রতি ভালোবাসা দেখাও। অন্তত এক কাপ চা বানিয়ে মাকে খাওয়াও।’ তখন ওই পত্রিকায় ‘ভালোবাসার দিন’ নিয়ে লেখাও আহ্বান করেন সম্পাদক শফিক রেহমান।বিপুলসংখ্যক পাঠক নিজ নিজ ভালোবাসার গল্প লিখে চিঠি পাঠায় পত্রিকাটিতে। পরবর্তী সময়ে ধীরে ধীরে ব্যাপক আকারে ১৪ জানুয়ারিকে ‘ভালোবাসা দিবস’ হিসেবে পালন করা শুরু হয় বাংলাদেশে।
‘লাভ লেন’:- ভালোবাসা দিবস পালন শুরুর পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার একটি সড়কের নাম ‘লাভ লেন’ রাখতে সক্ষম হয়েছেন শফিক রেহমান। আসলে তিনি নিজে যখন প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন,তখন চট্টগ্রামে ডিসি হিলের উল্টোদিকে ছোট্ট একটি রাস্তার নাম ছিল লাভ লেন। এই লেনের শুরুতে পানের দোকান ছিল। প্রেমিক-প্রেমিকারা সেখানে এসে পান খেত। পানের আকৃতিও ছিল হৃদয়ের মতো। শফিক রেহমান যখন যায়যায়দিনের প্লট বুকিং দেন তখন সেই রাস্তাগুলোর কোনো নাম ছিল না। এ সুযোগে তৎকালীন নগরপিতার মাধ্যমে এলাকাবাসীর আগ্রহে তেজগাঁওয়ের এ রাস্তার নাম রাখা হয় ‘লাভ লেন’।