রেখা পাঠক(প্রবাসী লেখক): প্রথম ধাপঃ-
১৪২৮বাংলার ২২শে মাঘ শনিবার,২০২২ইংরেজির ৫ই ফেব্রুয়ারি বসন্তপঞ্চমী তিথি। এই তিথিটি হল মা সরস্বতী কে আহ্বান,বন্দনা এবং পূজা-অর্চনা করার দিন-ঘটে,পটে,প্রতিমাতে,বিদ্যালয়ে,বাড়িতে,মণ্ডপে-মণ্ডপে। মা সরস্বতী হলেন ” বিদ্যা,বুদ্ধি,স্মৃতি, জ্ঞান,শক্তি,প্রতিভা,কল্পনা-শক্তি,সংখ্য,কর্তৃত্ব-শক্তি “। ছয় রাগ,ছয়ত্রিশ রাগিনী,বেণুবীণা এবং নানাবিধ বাদ্যযন্ত্রের অধীশ্বরী দেবী। এত সবের অধীশ্বরী দেবী সরস্বতী কেমন? বেদ-পুরাণে প্রবেশের আগে, সরস্বতীর বরপুত্র কিংবা মানবদেহে স্বয়ং সরস্বতীর অবতার বিশ্বকবি,কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর “পুরষ্কার ” কবিতার কবি,কবি রূপী রবীন্দ্রনাথ সনাতন শাস্ত্র মথিত করে সরস্বতীর বন্দনা করেছেন এই ভাবেঃ-
“প্রকাশো,জননী,নয়নসমুখে
প্রসন্ন মুখছবি॥
বিমল মানসসরসবাসিনী,
শুক্লবসনা শুভ্রহাসিনী,
বীণাগঞ্জিত মঞ্জুভাষিণী
কমলকুঞ্জাসনা,
তোমারে হৃদয়ে করিয়া আসীন
সুখে গৃহকোণে ধনমানহীন
খ্যাপার মতন আছি চিরদিন
উদাসীন আনমনা॥
চারিদিকে সবে বাঁটিয়া দুনিয়া
আপন অংশ নিতেছে গুনিয়া–
আমি তব স্নেহবচন শুনিয়া
পেয়েছি স্বরগসুধা॥
সেই মোর ভালো,সেই বহু মানি-
তবু মাঝে মাঝে কেঁদে ওঠে প্রাণী,
সুরের খাদ্যে জান তো মা বাণী,
নরের মিটে না ক্ষুধা।
যা হবার হবে,সে কথা ভাবি না,
মা গো,একবার ঝংকারো বীণা,
ধরহ রাগিণী বিশ্বপ্লাবিনা
অমৃত-উৎস-ধারা॥
যে রাগিণী শুনি নিশিদিনমান
বিপুল হর্ষে দ্রব ভগবান
মলিন মর্ত-মাঝে বহমান
নিয়ত আত্মহারা।
যে রাগিণী সদা গগন ছাপিয়া
হোমশিখাসম উঠিছে কাঁপিয়া,
অনাদি অসীমে পড়িছে ঝাঁপিয়া,
বিশ্বতন্ত্রী হতে॥
যে রাগিণী চির-জন্ম ধরিয়া
চিত্তকুহরে উঠে কুহরিয়া,
অশ্রুহাসিতে জীবন ভরিয়া,
ছুটে সহস্র স্রোতে।
কে আছে কোথায়,কে আসে কে যায়,
নিমেষে প্রকাশে,নিমেষে মিলায়–
বালুকার ‘পরে কালের বেলায়
ছায়া-আলোকের খেলা!
জগতের যত রাজা-মহারাজ
কাল ছিল যারা কোথা তারা আজ,
সকালে ফুটিছে সুখদুখলাজ–
টুটিছে সন্ধ্যাবেলা।
শুধু তার মাঝে ধ্বনিতেছে সুর
বিপুল বৃহৎ গভীর মধুর–
চিরদিন তাহে আছে ভরপুর
মগন গগনতল।
যে জন শুনেছে সে অনাদি ধ্বনি
ভাসায়ে দিয়েছে হৃদয়তরণী;
জানে না আপনা,জানে না ধরণী,
সংসার-কোলাহল।
সে জন পাগল,পরান বিকল–
ভবকূল হতে ছিঁড়িয়া শিকল
কেমনে এসেছে ছাড়িয়া সকল
ঠেকেছে চরণে তব।
তোমার অমল কমলগন্ধ
হৃদয়ে ঢালিছে মহা আনন্দ–‘
অপূর্ব গীত,আলোক ছন্দ
শুনিছে নিত্য নব।
বাজুক সে বীণা,মজুক ধরণী,
বারেকের তরে ভুলাও জননী,
কে বড়ো কে ছোটো,কে দীন কে ধনী,
কেবা আগে কেবা পিছে–॥
কার জয় হল কার পরাজয়,
কাহার বৃদ্ধি কার হল ক্ষয়,
কেবা ভালো আর কেবা ভালো নয়,
কে উপরে কেবা নীচে।
গাঁথা হয়ে যাক এক গীতরবে
ছোটো জগতের ছোটো-বড়ো সবে,
সুখে প’ড়ে রবে পদপল্লবে
যেন মালা একখানি।
তুমি মানসের মাঝখানে আসি
দাঁড়াও মধুর মুরতি বিকাশি,
কুন্দবরন সুন্দর হাসি
বীণাহাতে বীণাপাণি।
ভাসিয়া চলিবে রবিশশীতারা
সারি সারি যত মানবের ধারা
অনাদিকালের পান্থ যাহারা
তব সংগীতস্রোতে।
দেখিতে পাইব ব্যোমে মহাকাল
ছন্দে ছন্দে বাজাইছে তাল,
দশ দিক্বধূ খুলি কেশজাল
নাচে দশ দিক হতে।”
‘পুরস্কার ‘ কবিতার কবি( মানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)সুরলোকের যে অমৃতময় বাণী দিয়ে বৈদিক শাস্র পুরাণের দেবী সরস্বতীর স্বরূপ বর্ণনা,সরস্বতীর রাগ রাগিণীর মাধুর্য মহিমা বর্ণনা করেছেন,তারপর আর সরস্বতী সম্পর্কে কিছুই বলার থাকেনা আমার মতে। মানুষ নিজের কথা নিজে যে-ভাবে বলতে পারে,অন্যে সে ভাবে পারেনা।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই বাক্ পতি সরস্বতী। তাই তো কালের সর্ব শ্রেষ্ঠ বাণী বন্দনা করেছেন বাণী চয়নে দেবীর বাণী প্রতিমা নির্মাণ করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে যারা বলেন নিরাকার ব্রহ্মবাদী, আমার মতে তা অযৌক্তিক,কারণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর সমস্ত সৃষ্টিই অমৃতময় বাণী দিয়ে সৃষ্ট করেছেন
সাকার ভগবানের বাণীময় মধুর মূর্তি। আলোচ্য ‘পুরস্কার’কবিতার এই অংশবিশেষই তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যদি সাকারবাদী না হতেন,তাহলে অমৃত পিপাসী মানুষ আর যা-ই হোক,
গীতবিতানের মত অমৃতের আস্বাদন হতে বঞ্চিত থাকত। দুঃখী মানুষ কে অপার্থিব চিন্ময় আনন্দ দানের জন্যই সর্বশক্তিমান ঈশ্বর সাকার রূপ ধারণ করেন।
ঈশ্বরের সাকার রূপের কারণেই সনাতনধর্ম এত বিচিত্র নান্দনিক শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির বিশ্বনন্দিত,বিশ্ববন্দিত,বিশ্বের বিস্ময়!যেখানে প্রতিমা পূজা নেই,সেখানে কোনো শুদ্ধ, সুন্দর,নির্মল আনন্দদায়ক নানন্দিক কোনো সংস্কৃতি থাকতে পারেনা।
“দেবী সরস্বতী এক শক্তি। সকল দেবদেবী এক একশক্তি। শক্তি নিরাকার। নিরাকারের আকার কল্পনা হইতে পারেনা।নিষ্কিয় শক্তির সত্তা অনুভূত হয় না। তাহার ধ্যান ও ধারণা আমাদের অগম্য। শক্তি সক্রিয় হইলে আমরা কর্ম দেখিয়া তাহার সত্তা অনুভব করি।বাক্য দ্বারা সে কর্ম বর্ণনা করিতে পারি। সে বর্ণনা শক্তির বাঙময়ী প্রতিমা। শব্দজ্ঞানহীন চঞ্চল চিত্ত অল্পমতির নিকটে বাঙময়ী প্রতিমা পরিস্ফুট হয় না। তাহাদের নিমিত্ত জড়ময়ী প্রতিমার প্রয়োজন হইয়া থাকে। মৃত্তিকা শিলা ধাতু দারু ও চিত্র, এই বিবিধ উপায়ে জড়ময়ী প্রতিমা রচিত হয়।
চলবে…………………….