🔎মোহাম্মদ আলী।
সাম্য শব্দটির সঙ্গে আমরা পূণার্ঙ্গ পরিচয় হয়ে উঠি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘সাম্য’ কবিতার মাধ্যমে। সাম্য মানেই, সমান বা সমতা।
মানুষ সমাজে বসবাস করে। সমাজবদ্ধভাবে মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে বেঁচে থাকার জন্য সমান অধিকার নিয়ে বাঁচতে চায়। বতর্মানে সমাজে তিন শ্রেণির লোক বসবাস করে; উচ্চ-মধ্য-নিম্ন। এই তিন শ্রেণির লোক একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে থাকাটা অগ্রহণযোগ্য হয়ে পড়ে। নিম্ন শ্রেণির লোক সবসময় মধ্য-উচ্চবিত্তলোকদের সঙ্গে মিশে থাকতে চায়, কিন্তু মেশা তো দূরের কথা তাদের পাত্তাও দেয় না উচ্চবিত্ত লোকজন।
প্রাচীনকালে এই বাংলায় ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, ও শূদ্র এ চার প্রকার বর্ণের লোক বসবাস করত। এর মধ্যে ‘ব্রাহ্মণদের’ স্থান ছিল সমাজের সবোর্চ্চ স্থান যা বতর্মানে ‘উচ্চ শ্রেণির’ সঙ্গে প্রায় মিল রয়েছে। ‘ক্ষত্রিয়দের’ সঙ্গে বতর্মানে মিল খুঁজে পাওয়া যায় ‘মধ্যম শ্রেণির’ লোকদের। অন্যদিকে প্রাচীনকালে ‘শূদ্রদের’ স্থান ছিল করুন অবস্থা বতর্মানে মিল খুঁজে পাওয়া যায় ‘নিম্নশ্রেণির’ লোকদের। কিন্তু প্রাচীনকালে ব্রাহ্মণ বাদে অন্যসব বণের্র লোকজন একে অপরের সঙ্গে মেলামেশা করত।
বতর্মানে সমাজে উচ্চ-মধ্যম এরা সবসময় মিলেমিশে থাকতে চায়। আর নিম্নে বণের্র লোকদের সঙ্গে কেউ মিশতে চায় না। কেউ তাদের কোনো কাজের পাত্তাও দেয় না, কথা বলা তো দূরের কথা, কোনো ন্যায্য কথার মূল্য দেয় না। যে কোনো কথা হুমকি -ধমকি দিয়ে বন্ধ রাখে। অসহায় গরিব পরিবারের সন্তানরা উচ্চশিক্ষিত হলেও তাদের সম্মান তো দূরের কথা কিছু স্বার্থপর সমাজকর্মীরা টাকার দাপটে সম্মানহানী করে। এমনকি- মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখে। এটা কি হতে পারে সাম্যের সমাজ?
সামাজিক সাম্য সঠিকভাবে ব্যবহার হতে না পারলে একদিন অসাম্যের সমাজ গড়ে উঠবে। ফলে সমাজে একদিন ববর্রতা, হানাহানি, মারামারি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা অন্ধকারে রূপ নেবে।
এসবের পিছনে একদিন কারণ হয়ে দাঁড়াবে সমাজের যুবসমাজ। বতর্মানে আমাদের সমাজ জীবনে চরম অবক্ষয়ের চিত্র জীবন্ত হয়ে আছে। এই অবক্ষয় যুবসমাজকে প্রভাবিত করছে, দোলা দিচ্ছে তাদের মন-মানসিকতাকে। আমাদের যুব সমাজের সামনে আজ কোনো আদর্শ নেই। নেই অনুপ্রাণিত করার মন কোনো মহৎপ্রাণ আলোকিত মানুষ। ঘরে-বাইরে সর্বত্রই মনুষ্যত্বের দীনতার চিত্র। সাম্যর সমাজকে নতুন চেতনায় উদ্দীপ্ত করার মতো কোনো পরিকল্পনা নেই, ফলে যুবকরা প্রতিনিয়ত ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সমাজে সমাজ বিরোধীর যে সম্মান, যে প্রতিপত্তি, সেখানে একজন জ্ঞানী, সৎ মানুষের মূল্য তুচ্ছ। সৎ মানুষ সেখানে লাঞ্চিত, অসহায়। বিবেক সেখানে বিবজির্ত। জ্ঞানী-গুণীরাও তাদের খাতির করে। জঘন্য, নিষ্ঠুর কাজকর্ম করে ও তারা সমাজের চোখে নিরাপদ।
সমাজের প্রভাবশালীরা অনায়াসে মানুষ খুন করে, ডাকাতি করে, জনজীবনে ত্রাসের সৃষ্টি করে। কোনো অন্যায় আজ অন্যায় বলে বিবেচিত হচ্ছে না। নীতিভ্রষ্ট মানুষ আজকের দিনে নিজেকে অপরাধীও বলে বিবেচনা করে না। দূর্নীতির মাধ্যমে বিত্তশালী হয়েও তারা সঙ্কোচবোধ করে না। বরং অর্থের গৌরবে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করে।
অবৈধ উপায়ে উপার্জনের প্রতিযোগিতা চলছে সমাজে। সমাজে প্রভাবশালীরা অর্থের দাপটে অযোগ্য লোকদের চাকরি দিয়ে দিচ্ছে; ওইদিকে পড়ে থাকে উচ্চ-শিক্ষিত কৃষকের ছেলেমেয়ে, চাকরি তো দূরের কথা একটু আশাও দেয় না। নিঃশ্বাসের আর শেষ থাকে না দুঃখিনীদের। যখন পড়ালেখা শেষ করে অর্থসংকটের অভাবে চাকরি মেলে না তখন কৃষকের ছেলেমেয়েদের অবস্থা কিরূপ হতে পারে?? কে দেবে তাকে আলোর পথের সন্ধান? কে নিয়ে যাবে সেই আলোর পথে?
আমাদের দেশ সমাজে সর্বত্র একটা অস্থিরতা। সব মানুষ যেন অধীর, সবাই যেন কোনো না কোনো অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। শিক্ষার প্রতি অনুরাগ, ন্যায়ের প্রতি কারও আগ্রহ নেই। বেড়েছে ভোগবাদী প্রবণতা, কর্তব্যের প্রতি অবহেলা, সহানুভবতার পরিবর্তে মানুষের প্রতি মানুষের অবহেলা, স্বার্থ সাধনের জন্য ব্যাপক তৎপরতা, জনকল্যাণের প্রতি অনীহা। এসব মূল্যবোধহীন মানুষের জীবনকে অস্থির করে তুলছে। আমাদের সমাজে বেড়েছে সন্ত্রাসী কমর্কান্ড, বেড়েছে দুর্নীতে মূল্যবোধের অবক্ষয় অনিশ্চয়তা, অস্থিরতা, দারিদ্র্য। কিন্তুু বাড়ছে না মানুষের জন্য মানুষের সংবেদনশীল আচরণের। কিন্তু কেন?
কেন এর উত্তর খুঁজে বের করতে গেলে নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাব দেখা দেয়। নৈতিক মূল্যবোধের অভাবে জাতি আজ চরম সংকটে পতিত হয়েছে। সমাজের নৈতিক অধঃপতনের কারণে সামাজিক সমস্যা বাড়ছে এর ফলে সমাজজীবন অস্থির ও অশান্ত হয়ে উঠছে। মানুষের মধ্যে ভোগবাদী প্রবণতা বেড়ে যাওয়ায় সমাজের লোভ, মিথ্যাচার, আদশর্হীনতা, উচ্ছৃঙ্খলতা, ঘুষ, জালিয়াতি, রাহাজানি, ইত্যাদি সমাজবিরোধী কমর্কান্ড বেড়ে গেছে সর্বোপরি নৈতিক শিক্ষার জন্য সমাজে যে আদর্শ থাকার কথা তা ক্রমেই নানা কারণে হ্রাস পেয়েছে, ফলে অনৈতিক মূল্যবোধ শূন্যতা দেখা দিয়েছে।
এই সব দূর করার জন্য সামাজিক সাম্য এমনভাবে হতে হবে যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ও পেশাগত কারণে যখন মানুষে মানুষে কোনো পার্থক্য করা হবে না এবং সমাজে বসবাসরত সব মানুষ যোগ্যতা অনুযায়ী একই ধরনের সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবে। ধনী-গরিব হবে ভাই ভাই; কোনো ধরনের বৈষম্য থাকবে না। বিশেষ করে উচ্চবিত্ত লোকদের খেয়াল করতে হবে সমস্ত মৌলিক অধিকার থেকে যাতে বঞ্চিত না হয় দরিদ্ররা সেই দিকে নজর দিতে হবে।
এজন্য হাত বাড়াতে হবে বিত্তশালীদের সমাজে বাসকৃত অসহায়,দরিদ্র ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষের দিকে সবাই সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে কিনা? এবং সমাজের বসবাসরত প্রতিবন্ধীদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সমানভাবে দিচ্ছে কিনা; সমাজের তরুণ মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা অর্থ সংকটে পড়ালেখা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কিনা; সমাজ কল্যাণের ক্ষেত্রে সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের নীতিমালা গ্রহণ করে। কিন্তু সেই নীতিমালা ধনি শ্রেণির লোকের গায়ের জোরে নিজেরাই পরিবর্তন করে সেদিকে সোচ্চার হতে হবে সব নাগরিকের। অসাম্যের সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে একমাত্র আদর্শ যুবকরা। তারা পারে সমাজে যত দ্বন্দ-কলহ,