সত্যজিৎ দাস(স্টাফ রিপোর্টার):
প্রবোধ চন্দ্র দে ডাক নাম ” মান্না দে “।৫ বছর হলো কিংবদন্তী মান্না দেকে আমরা হারিয়েছি । আজ বুধবার ২৪শে অক্টোবর,তাঁর পঞ্চমতম মৃত্যু বার্ষিকী । তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেলেও তাঁর গানকে ছেড়ে দিতে পারেনি কেউ । আজও প্যাণ্ডেলে প্যান্ডেলে বাজে তাঁরই গান । ”ও কেন অতো সুন্দরী হলো” এই গানে শুনে জেন আজও নিজেকে নতুন করে খুঁজে পায় প্রেমিক প্রেমিকাকে ।
বাবা-পূর্ণ চন্দ্র এবং মা- মহামায়া দে’র সন্তান মান্না দে ১ মে ১৯১৯ সালে জন্ম। বাবা-মায়ের সংস্পর্শ ছাড়াও, পিতৃসম্বন্ধীয় সর্বকনিষ্ঠ কাকা সঙ্গীতাচার্য (সঙ্গীতে বিশেষভাবে দক্ষ শিক্ষক) কে.সি. দে (পূর্ণনাম: কৃষ্ণ চন্দ্র দে) তাকে খুব বেশি অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত করেছেন। দে তার শৈশব পাঠ গ্রহণ করেছেন ‘ইন্দু বাবুর পাঠশালা’ নামে একটি ছোট প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তারপর তিনি স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুল এবং স্কটিশ চার্চ কলেজে স্নাতক শিক্ষাগ্রহণ করেছিলেন। স্কটিশ চার্চ কলেজে অধ্যয়নকালীন তিনি তার সহপাঠীদেরকে গান শুনিয়ে আসর মাতিয়ে রাখতেন। তিনি তাঁর কাকা কৃষ্ণ চন্দ্র দে এবং উস্তাদ দাবির খানের কাছ থেকে গানের শিক্ষা লাভ করেন। ঐ সময়ে মান্না দে আন্তঃকলেজ গানের প্রতিযোগিতায় ধারাবাহিকভাবে তিন বছর তিনটি আলাদা শ্রেণীবিভাগে প্রথম হয়েছিলেন।
মান্না দে ১৯৪২ সালে কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র সাথে বোম্বে (বর্তমান মুম্বাই) দেখতে আসেন। সেখানে শুরুতে তিনি কৃষ্ণ চন্দ্র দে’র অধীনে সহকারী হিসেবে এবং তারপর শচীন দেব বর্মণ (এস.ডি. বর্মণ) এর অধীনে কাজ করেন। পরবর্তীতে তিনি অন্যান্য স্বনামধন্য গীতিকারের সান্নিধ্যে আসেন এবং তারপর স্বাধীনভাবে নিজেই কাজ করতে শুরু করেন। ঐ সময় তিনি বিভিন্ন হিন্দি চলচ্চিত্রের জন্য সঙ্গীত পরিচালনার পাশাপাশি উস্তাদ আমান আলি খান এবং উস্তাদ আব্দুল রহমান খানের কাছ থেকে হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নেন।
তিনি ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম সেরা সংগীত শিল্পী এবং সুরকারদের একজন। হিন্দি, বাংলা, মারাঠি, গুজরাটিসহ প্রায় ২৪টি ভাষায় তিনি ষাট বছরেরও অধিক সময় সংগীত চর্চা করেছিলেন। আলিপুরদুয়ারে তাঁর গুণগ্রাহী দেবপ্রসাদ দাস নিজের বাড়িতে মান্না দে সংগ্রহশালা তৈরি করেছেন।বৈচিত্র্যের বিচারে তাঁকেই ভারতীয় গানের ভুবনে সবর্কালের অন্যতম সেরা গায়ক হিসেবে স্বীকার করে থাকেন অনেক বিশেষজ্ঞ সংগীত বোদ্ধা।কলকাতায় ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে এই কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী তথা সুরকারের জন্ম শতবর্ষ অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করা হয়। কলকাতাতেই প্রায় একশো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।উত্তর কলকাতায় তাঁর বাসস্থানের কাছে মর্মর মূর্তি স্থাপন করা হয়।
মান্না দে গায়ক হিসেবে ছিলেন আধুনিক বাংলা গানের জগতে সর্বস্তরের শ্রোতাদের কাছে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় ও সফল সংগীত ব্যক্তিত্ব। এছাড়াও, হিন্দি এবং বাংলা সিনেমায় গায়ক হিসেবে অশেষ সুনাম অর্জন করেছেন। মোহাম্মদ রফি, কিশোর কুমার, মুকেশের মতো তিনিও ১৯৫০ থেকে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের দশক পর্যন্ত ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতে সমান জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। সংগীত জীবনে তিনি সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি গান রেকর্ড করেন।
কেরলর মেয়ে সুলোচনা কুমারনকে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৫৩ সালে বিয়ে করেন। তাদের দুই কন্যা রয়েছে: শুরোমা (জন্মঃ ১৯ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে) এবং সুমিতা (জন্মঃ ২০ জুন ১৯৫৮ সালে) জন্মগ্রহণ করে। মান্না দে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি সময় মুম্বাইয়ে কাটানোর পর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত বেঙ্গালুরুর কালিয়ানগর শহরে বাস করেছেন। এছাড়াও, তিনি কলকাতায়ও বাস করেছেন। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বেও তিনি বিভিন্ন সঙ্গীতবিষয়ক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেছিলেন।
‘তামান্না’ (১৯৪৩) চলচ্চিত্রে গায়ক হিসেবে মান্না দে‘র অভিষেক ঘটে। সুরাইয়া’র সাথে দ্বৈত সঙ্গীতে গান এবং সুরকার ছিলেন কৃষ্ণ চন্দ্র দে। ঐ সময়ে গানটি ভীষণ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ‘মশাল’ (১৯৫০) ছবিতে শচীন দেব বর্মণের গীত রচনায় ‘ওপার গগন বিশাল’ নামে একক গান গেয়েছিলেন। এর গানের কথা লিখেছিলেন কবি প্রদীপ। ১৯৫২ সালে মান্না দে বাংলা এবং মারাঠী ছবিতে একই নামে এবং গল্পে ‘আমার ভূপালী’ গান গান। এরফলেই তিনি প্রতিষ্ঠিত ও পাকাপোক্ত করেন এবং জনপ্রিয় গায়ক হিসেবে সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছ থেকে স্বীকৃতি পান।
মান্না দে ভীমসেন জোসি’র সাথে একটি জনপ্রিয় দ্বৈত গান ‘কেতকী গুলাব জুহি’ গান। এছাড়াও, তিনি কিশোর কুমারের সাথে আলাদা গোত্রের দ্বৈত গান হিসেবে ‘ইয়ে দোস্তী হাম নেহী তোড়েঙ্গে (শোলে)’ এবং ‘এক চতুর নার (পডোসন)’ গান। এছাড়াও, মান্না দে শিল্পী ও গীতিকার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় (হেমন্ত কুমার)সহ আরো বেশকিছু গীতিকারের সাথে বাংলা ছবিতে গান গেয়েছিলেন। দ্বৈত সঙ্গীতে লতা মঙ্গেশকরের সাথে ‘কে প্রথম কাছে এসেছি (শঙ্খবেলা)’ গান করেছেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতসহ প্রায় ৩৫০০ গান গেয়েছেন মান্না দে। তিনি অসংখ্য শ্যামাসংগীত গান করেছেন!২০১৩ সালের ৮ই জুন ফুসফুসের জটিলতা দেখা দেওয়ায় মান্না দে কে বেঙ্গালুরুর একটি হাসপাতালের আইসিইউ তে ভর্তি করা হয়। ৯ই জুন, ২০১৩ সালে তার মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়লে ডাক্তাররা এই গুজবের অবসান ঘটান এবং নিশ্চিত করেন যে তিনি তখনও বেঁচে আছেন তবে তার অবস্থার বেশ অবনতি হয়েছে এবং আরও কিছু নতুন জটিলতা দেখা দিয়েছে।পরবর্তিতে ডাক্তাররা তার অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে জানান। মান্না দে ২৪শে অক্টোবর ২০১৩ সালে বেঙ্গালুরুতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
জনপ্রিয় গানসমূহঃ কফি হাউজের সেই আড্ডাটা,আবার হবে তো দেখা,এই কূলে আমি,আর ওই কূলে তুমি, তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়,
যদি কাগজে লেখো নাম,সে আমার ছোট বোন,শাওন রাতে যদি।
পুরস্কার ও সম্মাননাঃ-১৯৭১ সালে পদ্মশ্রী,২০০৫ সালে পদ্মবিভূষণ,২০০৭ সালে দাদাসাহেব ফালকে সম্মাননায় অভিষিক্ত করে তাঁকে।২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজ্যের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান বঙ্গবিভূষণ।
২০১৩ সালের ৮ই জুন ফুসফুসের জটিলতা দেখা দেওয়ায় মান্না দে কে বেঙ্গালুরুর একটি হাসপাতালের আইসিইউ তে ভর্তি করা হয়। ৯ই জুন ২০১৩ সালে তাঁর মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়লে ডাক্তাররা এই গুজবের অবসান ঘটান এবং নিশ্চিত করেন যে তিনি তখনও বেঁচে আছেন তবে তার অবস্থার বেশ অবনতি হয়েছে এবং আরও কিছু নতুন জটিলতা দেখা দিয়েছে। পরবর্তীতে ডাক্তাররা তাঁর অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন। কিন্তু ২৪শে অক্টোবর ২০১৩ সালে বেঙ্গালুরুতে ” মান্না দে ” পরলোক গমন করেন।