রেখা পাঠক,কানাডা:
দ্বিতীয় পর্বঃ-
রঘুনাথদাসের সেক্রেটারির কাজও কৃষ্ণদাস করতেন। বৃন্দাবনের গোস্বামীদের দাতব্য ভাণ্ডারের ভার কৃষ্ণদাসের উপর ছিল এবং সে ভার বহন করে তিনি সকলের প্রশংসা অর্জন করেছিলেন। সে কথা নরহরি চক্রবর্তীর উক্তি হতে আমরা জানতে পারি। কৃষ্ণদাস যে বৈরাগী ছিলেন না তার প্রমাণ তাঁরই উক্তিতে পাই–
‘ ক্ষুদ্র নীচ মূর্খ মুই বিষয়লালস,
বৈষ্ণবাজ্ঞা বলে করি এতেক সাহস ‘।।
‘কৃষ্ণদাসের গুরু ছিলেন নিত্যানন্দ। নিত্যানন্দের এই অনুগ্রহ প্রসঙ্গে৷ কৃষ্ণদাস নিজের হীনতা প্রকাশ করে যে মন্তব্যটি করেছেন,তা তাঁর পরিচয় বিষয়ে ভাবনা জাগায়——————————“জগাই মাধাই হৈতে মুঞি সে পাপিষ্ঠ।
পুরীষের কীট হৈতে মুঞি সে লঘিষ্ঠ।।
মোর নাম শুনে যেই তার পুণ্য ক্ষয়।
মোর নাম লয় যেই তার পাপ হয় ।।
এমন নির্ঘৃণ মোরে কেবা কৃপা করে।
এক নিত্যানন্দ বিনু জগৎ সংসারের।।
প্রেমে মত্ত নিত্যানন্দ কৃপা অবতার।
উত্তম অধম কিছু না করে বিচার।।
যে আগে পড়য়ে তারে করয়ে নিস্তার।
অতএব নিস্তারিল মো হেন দুরাচার।।”
প্রসঙ্গক্রমে এসে যায় যে,সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠগ্রন্থ রাজির মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত।
এ হেন মহান এবং মহৎ গ্রন্থের রচয়িতা হয়ে (শুধু চৈতন্যচরিতামৃত নয়,সংস্কৃত এবং বাংলায় একাধিক মহামূল্যবান গ্রন্থের রচয়িতা) শ্রীলকৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী নিজেকে কী দীন হীন,কী অধম বলে প্রকাশ করেছেন! আসলে বৈষ্ণবীয় জগৎটাই দীনতা, সহনশীলতা আর মানহীনকে মান্য করার এক আত্মগরিমাহীন অহংকার,অহমিকাহীন বিনয়ের জগৎ। গৌঁড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের প্রবর্তক প্রচারক যে বিশ্বম্ভর মিশ্র, শ্রীকৃষ্ণচৈতন্যমহাপ্রভু,তিনি তো ছিলেন বিনয়ের অবতার,দীনতার খনি।তাঁরই তো বাণী এবং শিক্ষা -“উত্তম হইয়া বৈষ্ণব হইবে নির অভিমান ।
জীবে সম্মান দিবে জানি কৃষ্ণ অধিষ্ঠান।।
আর” তৃণাদপি সুনীচেন তরোরিব সহিষ্ণুণা।
অমানিনা মানদেন কীর্ত্তনীয়ঃ সদা হরিঃ।।
এর বাংলা হলো;- তৃণ অর্থাৎ ঘাস অপেক্ষা নীচ হয়ে,বৃক্ষের ন্যায় সহনশীল হয়ে,আপন অভিমান বিসর্জন দিয়ে,যে জগতে সকলের কাছে মানহীন,সেই মানহীনকে মান অর্থাৎ সম্মান দিয়ে নিরন্তর হরিনাম করা। শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভু শাস্ত্র গ্রন্থ বিচারে স্বয়ং ঈশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ই শুধু নয়, শ্রীরাধাকৃষ্ণের মিলিত বিগ্রহের অবতারী কলিকালে। কিন্তু তিনি নিজেকে কখনো ভগবান বলে প্রচার বা প্রতিষ্ঠা করেননি,তিনি কৃষ্ণ প্রেমে পাগল এক দীনার্থ ভক্ত রূপে আচণ্ডালে বক্ষে জড়িয়ে ধরে সর্বজীবে প্রচার করেছেন কৃষ্ণ প্রেম আর মানব প্রেম। ডঃ সুকুমার সেন বলেন,”কৃষ্ণদাস চৈতন্যচরিতামৃত লিখেছিলেন বৃন্দাবনের কয়েকজন বৈষ্ণব মহান্তের অনুরোধে। “ডঃ সুকুমার সেন এর কারণ হিসেবে বলেছেন যে,বৃন্দাবনের মহান্তগণ একত্রিত হয়ে বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য মঙ্গল ( পরে যা চৈতন্যভাগবত নামে নামকরণ হয়) গ্রন্হখানি পাঠ শুনতেন। কিন্তু বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যমঙ্গল/চৈতন্যভাগবতে শ্রীচৈতন্যদেবের নীলাচল/পুরীধামের শেষ আঠারো অনুক্ত বিবরণ শুনার জন্য। কারণ,একদিকে কৃষ্ণদাসের লেখনী ক্ষমতার কথা বৃন্দাবনের গোস্বামী প্রভুগণ অবগত ছিলেন।অন্যদিকে পুরীতে শ্রীচৈতন্যের প্রত্যক্ষ লীলা দর্শনকারী শ্রীরঘুনাথ দাস গোস্বামীকে দেখভাল করার কারণে,তাঁর কাছ থেকে মহাপ্রভুর গম্ভীরা লীলা অবগত হয়েছিলেন কৃষ্ণ দাস। রঘুনাথ দাস গোস্বামী মহাপ্রভুর জীবদ্দশায় পুরীতে ছিলেন,মহাপ্রভুর লীলা সংবরণের পর রঘুনাথ ভেঙে পড়লে স্বরূপ দামোদরের স্নেহচ্ছায়ায় তাপিত জীবন জুড়ান,কিন্তু স্বরূপ দামোদর অপ্রকটিত হলে পর রঘুনাথ সিদ্ধান্ত নেন যে বৃন্দাবনে গিয়ে গোবর্ধন হতে ভৃগুপাত করবেন। কিন্তু বৃন্দাবনে আসার পর তিনি রূপ,সনাতন গোস্বামীদের চরণে আশ্রিত হলে তাঁরা তাঁকে ভৃগুপাতের পথ হতে রক্ষা করে কৃষ্ণদাসের দেখভালে রাখেন। রঘুনাথ পুরীতে থাকাকালে শ্রীচৈতন্যের গম্ভীরায় মহাপ্রভুর সাথে রায়রামানন্দের একান্তে যে “সাধ্য-সাধনতত্ত্ব” আলাপ হতো তা স্বরূপ দামোদরের কাছ থেকে রঘুনাথ জেনেছিলেন। কৃষ্ণদাস জেনেছিলেন রঘুনাথের কাছ থেকে। শাস্ত্র শিরোমণি কৃষ্ণদাস কবিরাজ শাস্ত্রের সাথে রঘুনাথদাস গোস্বামীর মাধ্যমে গম্ভীরায় স্বরূপ দামোদরের প্রত্যক্ষ দর্শনের ওপর ভিত্তি করে শ্রীচৈতন্যকে “রাধাভাবদ্যুতি সুবলিত” ভক্তরূপে ঈশ্বর কৃষ্ণের অবতার বলে কলির যুগাবতার শ্রীচৈতন্যকে নিয়ে সৃষ্টি করলেন গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের বেদতুল্য গ্রন্হ “শ্রী শ্রী চৈতন্যচরিতামৃত”। চৈতন্য অবতারে “হরিনাম সংকীর্তন” চৈতন্যের বর্হির অঙ্গের দান,গম্ভীরায় রায়রামানন্দের সাথে অন্তরঙ্গে রসাস্বাদন কালে সাধ্য-সাধন তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করতে করতে রায় রামানন্দ যা দেখলেন,তা জিজ্ঞাসা করলেন মহাপ্রভুকে;………………… “পহিলে দেখিলুঁ তোমা সন্ন্যাসী স্বরূপ।
এবে কেন দেখি তোমা শ্যাম গোপরূপ।।
তোমার সম্মুখে দেখি কাঞ্চন পঞ্চালিকা।
তাঁর গৌর কান্ত্যে তোমার সর্বাঙ্গ ডাকা।।
তাতে এক প্রকট দেখি সবংশীবদন।
নানাভাবে চঞ্চলতার কমল নয়ন।।
রাধিকার ভাব কান্তি করি অঙ্গিকার।
নিজ রস আস্বাদিতে করিয়াছ অবতার।।
তবে হাসি তারে প্রভু দেখাইলা স্বরূপ।
রসরাজ মহাভাব মিলি এক রূপ।। শ্রী চৈতন্যচরিতামৃত মধ্যঃঅষ্টম। চৈতন্য অবতারের এই অন্তর্নিহিত রসতত্ত্ব গম্ভীরায় দর্শন করলেন রায়রামানন্দ,শ্রবণ করলেন স্বরূপ দামোদর আর রঘুনাথদাস গোস্বামী এবং রঘুকৃষ্ণ দাস জানালেন জগৎকে;…..
“রাধাকৃষ্ণ এক আত্মা দুই দেহ ধরি।
অন্যোন্যে বিলসে রস আস্বাদন করি।।
সেই দুই এক এবে চৈতন গোস্বামী ।
ভাব আস্বদিতে দোঁহে হৈলা এক ঠাঁঞি।।
রাধিকা হয়েন কৃষ্ণরে প্রণয় বিকার।
স্বরূপশক্তি হ্লাদিনী নাম যাঁহার।।
রাধা পূর্ণ শক্তি কৃষ্ণ পূর্ণ শক্তিমান।
দুই বস্তুতে ভেদ নাহি শাস্ত্রের প্রমাণ।। শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত,আদিঃচতুর্থ।
চৈতন্য চরিতামৃতে কৃষ্ণ দাস গৌরাঙ্গকে কেবল শ্রীকৃষ্ণের অবতার নয়,রাধাকৃষ্ণের মিলিত তনু নিয়ে
রাধার ভাব কান্তি ধারণ করে,কৃষ্ণ বিরহে রাধার বিরহ দশার মর্মান্তিক ভাষা চিত্র অঙ্কন করেছেন অন্তঃদশায় যা কৃষ্ণ দাসের চৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থ ছাড়া অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।
চলবে…………………………………….