বিনোদন ডেস্ক:
আজ ২রা নভেম্বর। ক্যালেন্ডারের পাতার এই দিনটা ভারতবর্ষের কয়েক কোটি মানুষের জন্য খুব স্পেশ্যাল,কারণ আজ তাঁদের প্রিয় তারকার জন্মদিন। এদিন ৫৬-য় পা দিলেন বলিউডের ‘কিং অফ রোম্যান্স’।
ব্যাস ইতনা সা খওয়াব হ্যায়…। এই ইতনা-টা যে কতটা তার মালুম পরতে পরতে পড়েছে সকলের। একের পর এক প্রাপ্তী। শাহরুখ খান থেকে শুরু করে আজ তিনি সারা দুনিয়ার কিং খান। বিশ্বজুড়ে ভক্তের সংখ্যা যাঁর বিপুল, সেই মানুষটার স্বপ্ন যে কতটা বড় তা বোধহয় এখনও সকলের অজানা।
দিল্লি থেকে চলে এসেছিলেন এক বুক স্বপ্ন নিয়ে। দিল্লি থেকে এসেছিলেন অভিনেতা হতে আর সে স্বপ্ন আজ বাস্তব। আশির দশকে টেলিভিশন সিরিজে অভিনয় দিয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে ফৌজি টেলিভিশন সিরিয়ালে কমান্ডো অভিমন্যু রাই চরিত্রে একজন নতুন অভিনেতা হিসেবে সুযোগ পান কাজের। পরে ১৯৮৯ সালে সার্কাস সিরিয়ালে তিনি মোটামুটি কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অভিনয় করেন, যেটি ছিল একজন সাধারণ সার্কাস অভিনেতার জীবন নিয়ে রচিত।
হেমা মালিনী তার অভিষেক সিনেমা ‘দিল আশনা হ্যায়’তে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন শাহরুখকে।
১৯৯২ সালে ‘দিওয়ানা’ সিনেমা দিয়ে তার বলিউডে অভিষেক ঘটে। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে ডর, বাজিগার, আনজাম, দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে, দিল তো পাগল হ্যায়, কুচ কুচ হোতা হ্যায়, কাভি খুশি কাভি গাম, স্বদেশ, দেবদাস, মাই নেম ইজ খান, চেন্নাই এক্সপ্রেস, হ্যাপি নিউ ইয়ার, রাম জানে, জোশ, ওম শান্তি ওম, রাব নে বানা দে জুড়ি, মোহাব্বাতেনের মতো সুপারডুপার হিট সিনেমা দিয়ে স্থান করে নিয়েছেন কোটি ভক্তের হৃদয়ে।
এসআরকে ” শাহরুখ খান ” ১৯৬৫ সালের ২রা নভেম্বর নতুন দিল্লির এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ভারতের নতুন দিল্লির পাঠান বংশোদ্ভূত।তার পিতা মীর তাজ মোহাম্মদ খান ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। তিনি খান আবদুল গাফফার খানের অনুসারী ছিলেন এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসর সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের পেশাওয়ারে (বর্তমান পাকিস্তান) বসবাস করতেন এবং ১৯৪৮ সালে ভারত বিভাজন হওয়ার পরে পেশাওয়ারের কিসা খাওয়ানি বাজার থেকে নতুন দিল্লি চলে আসেন।খানের মতে, তার পিতামহ মীর জান মুহাম্মদ খান আফগানিস্তানের পশতুন জনগোষ্ঠীর একজন ছিলেন।২০১০ সালের হিসাব অনুসারে, খানের পিতার পরিবারের কিছু অংশ এখনো কিসা খাওয়ানি বাজারে বসবাস করছেন। শাহরুখ খানের মাতা লতিফ ফাতিমা ছিলেন ঊর্ধ্বতন সরকারী প্রকৌশলী ইফতিখার আহমেদের কন্যা।তার মায়ের পরিবার ব্রিটিশ ভারতের রাওয়ালপিন্ডি থেকে এসেছিলেন। ১৯৫৯ সালে খানের মাতাপিতা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। শাহরুখ খান এক টুইটার বার্তায় নিজেকে “অর্ধেক হায়দ্রাবাদী (মায়ের দিক থেকে), অর্ধেক পাঠান (পিতার দিক থেকে) এবং অংশিক কাশ্মীরি (পিতামহীর দিক থেকে)” বলে উল্লেখ করেন। শাহরুখের চাচাতো ভাইদের দাবী তাদের পরিবার কাশ্মীরের হিন্দকোওয়ান বংশোদ্ভূত, পশতুন নয়, এবং তার পিতামহ আফগানিস্তান থেকে এসেছিলেন এই দাবীটির বিরোধিতা করেন।
খান দিল্লির পার্শ্ববর্তী রাজেন্দ্র নগর এলাকা বেড়ে ওঠেন৷ তার পিতার রেস্তোরাঁসহ একাধিক ব্যবসা ছিল, এবং তার একটি ভাড়া বাড়িতে মধ্যবিত্ত জীবনযাপন করতেন।খান মধ্য দিল্লির সেন্ট কলুম্বাস স্কুলে পড়াশোনা করেন, সেখানে তিনি লেখাপড়া এবং হকি ও ফুটবল খেলায় ভালো করেন।তিনি এই স্কুলের সর্বোচ্চ পুরস্কার সোর্ড অব অনার লাভ করেন। শুরুতে খান খেলাধুলায় তার কর্মজীবন শুরু করার কথা ভাবেন, কিন্তু তার কাঁধের একটি আঘাতের কারণে তিনি আর খেলাধুলা করতে পারবেন না বলে মনে করেন।খেলাধুলার পরিবর্তে তিনি যৌবনে মঞ্চনাটকে অভিনয় করতেন এবং বলিউডের অভিনেতাদের নকল করে তিনি প্রশংসা অর্জন করেন। তার প্রিয় অভিনয়শিল্পী ছিলেন দিলীপ কুমার, অমিতাভ বচ্চন ও মুমতাজ।তার শৈশবের একজন বন্ধু ও অভিনয়ের সঙ্গী ছিলেন অমৃতা সিং, যিনি পরবর্তী কালে বলিউডে অভিনয় করেন। খান হংসরাজ কলেজে (১৯৮৫-৮৮) অর্থনীতিতে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের জন্য ভর্তি হন, কিন্তু তার বেশিরভাগ সময় দিল্লির থিয়েটার অ্যাকশন গ্রুপের (টিএজি) সাথে কাটান,যেখানে তিনি মঞ্চ পরিচালক ব্যারি জনের অধীনে অভিনয়ের পাঠ গ্রহণ করেন। হংসরাজ কলেজ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে তিনি জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ায় গণযোগাযোগ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের জন্য ভর্তি হন, কিন্তু অভিনয় জীবন শুরুর লক্ষ্যে তিনি স্নাতকোত্তর সম্পন্ন না করেই এই প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করেন।বলিউডের তার কর্মজীবন শুরুর সময়ে তিনি দিল্লির ন্যাশনাল স্কুল অব ড্রামাতেও অভিনয়ের পাঠ গ্রহণ করেন।তার পিতা ১৯৮১ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন এবং তার মাতা ১৯৯১ সালে বহুমূত্রের জটিলতায় মৃত্যুবরণ করেন।খানের শেহনাজ লালারুখ (জ. ১৯৬০) নামে একজন বড় বোন আছেন,যিনি তাদের পিতামাতার মৃত্যুর পর বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়লে খান তার সেবা-যত্নের দায়িত্ব নেন।শেহনাজ এখনো তার ভাই ও তার পরিবারের সাথে মুম্বইয়ের বাড়িতে বসবাস করছেন।
তার জন্ম নাম শাহরুখ খান (অর্থ “রাজ মুখ”) রাখা হলেও কিন্তু তার নাম শাহ রুখ খান লিখতে পছন্দ করেন, এছাড়াও সাধারণত তাকে তার নামের সংক্ষেপ এসআরকে নামে ডাকা হয়।খান গৌরী চিব্বারের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, গৌরী পাঞ্জাবি হিন্দু ধর্মাবলম্বী৷ তারা ছয় বছর প্রেম করার পর ১৯৯১ সালের ২৫শে অক্টোবর ঐতিহ্যগত হিন্দু রীতিতে বিয়ে করেন।তাদের এক পুত্র আরিয়ান খান (জ. ১৯৯৭) ও এক কন্যা সুহানা খান (জ. ২০০০)।২০১৩ সালে তারা তৃতীয় সন্তানের পিতামাতা হন, তার নাম আব্রাম খান,সারোগেট মায়ের মাধ্যমে তার জন্ম হয়৷তার বড় দুই সন্তান বিনোদন শিল্পে আগমনের আগ্রহ প্রদর্শন করেছেন। খান বলে তার পুত্র আরিয়ান বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়ার ইউসিএস স্কুল অব সিনেম্যাটিক আর্টসে পড়াশোনা করছেন এবং লেখক-পরিচালক হতে আগ্রহী, অন্যদিকে সুহানা জিরো (২০১৮) চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন, এবং উচ্চতর শিক্ষার জন্য নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের টিশ স্কুল অব দি আর্টসে ভর্তি হবেন।খান ইসলাম ধর্ম পালন করলেও তিনি তার স্ত্রীর হিন্দু ধর্মকে সম্মান করেন৷ তার সন্তানেরাও দুটি ধর্মই পালন করে৷ বাড়িতে কুরআন ও হিন্দু দেবতাদের মূর্তি পাশাপাশি অবস্থান করে। শাহরুখ খানের উচ্চতা পাঁচ ফুট আট ইঞ্চি।
শাহরুখ খানের প্রধান চরিত্রে প্রথম কাজ ছিল লেখ ট্যান্ডনের টেলিভিশন ধারাবাহিক দিল দরিয়া। ১৯৮৮ সালে ধারাবাহিকটির শুটিং শুরু হয়, কিন্তু নির্মাণ বিলম্বের কারণে ১৯৮৮ সালে রাজ কুমার কাপুর পরিচালিত ফৌজি টেলিভিশন ধারাবাহিকে অভিনেতা হিসেবে তিনি আত্মপ্রকাশ করেন। এই ধারাবাহিকে আর্মি ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়, এবং তিনি কমান্ডো অভিমন্যু রাই চরিত্রের অভিনয় করেন।এরপর তিনি সাধারণ সার্কাস অভিনেতার জীবন নিয়ে নির্মিত আজিজ মির্জার টেলিভিশন ধারাবাহিক সার্কাস (১৯৮৯-১৯৯০)-এ কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অভিনয় করেন এবং মণি কৌলের মিনি ধারাবাহিক ইডিয়ট (১৯৯১)-এ অভিনয় করেন।এছাড়া তিনি উম্মীদ (১৯৮৯) ও ওয়াগলে কি দুনিয়া (১৯৮৮-৯০) ধারাবাহিকে এবং অরুন্ধতী রায়ের ইংরেজি ভাষার ইন হুইচ অ্যানি গিভস ইট দোজ ওয়ানস (১৯৮৯) টেলিভিশন চলচ্চিত্রে গৌণ চরিত্রে অভিনয় করেন।এইসব ধারাবাহিকে তার অভিনয় দেখে সমালোচকগণ তার অভিনয়ের কৌশলকে দিলীপ কুমারের অভিনয়ের সাথে তুলনা করেন,কিন্তু খান তখনো চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য যথেষ্ট ভালো নন এই বিবেচনায় চলচ্চিত্রে অভিনয়ের প্রতি আগ্রহী ছিলেন না।
খান ১৯৯১ সালের এপ্রিলে তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন এবং এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন যে তিনি তার মায়ের মৃত্যুর দুঃখ ভুলতে চেয়েছিলেন। তিনি বলিউডে পূর্ণকালীন কর্মজীবন শুরু করার লক্ষ্য নিয়ে দিল্লি থেকে মুম্বই পাড়ি জমান এবং অচিরেই চারটি চলচ্চিত্রে চুক্তিবদ্ধ হন।ফৌজিতে তার অভিনয়ের মাধ্যমে তিনি হেমা মালিনীর নজর কাড়েন। হেমা মালিনী তাকে তার পরিচালনায় অভিষেক চলচ্চিত্র দিল আশনা হ্যায়-তে অভিনয়ের প্রস্তাব দেন।জুন মাসের মধ্যে তিনি তার প্রথম চলচ্চিত্রের শুটিং শুরু করেন।তার অভিনীত প্রথম ছবি দিল আশনা হ্যায় হলেও ১৯৯২ সালের জুনে মুক্তিপ্রাপ্ত দিওয়ানা ছবির মধ্য দিয়ে তার বড় পর্দায় অভিষেক হয়।এ ছবিতে তার বিপরীতে ছিলেন দিব্যা ভারতী এবং তিনি ঋষি কাপুরের পর দ্বিতীয় প্রধান পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করেন। দিওয়ানা ছবিটি বক্স অফিসে ব্যবসাসফল হয় এবং তিনি বলিউডে তার কর্মজীবন শুরু করতে সক্ষম হন। এই ছবিতে তার কাজের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ নবাগত অভিনেতা বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার লাভ করেন। একই বছরে মুখ্য চরিত্রে তার প্রারম্ভিক চলচ্চিত্রসমূহ চমৎকার, দিল আশনা হ্যায় ও রাজু বন গয়া জেন্টলম্যান মুক্তি পায়। শেষোক্ত চলচ্চিত্রে তিনি অভিনেত্রী জুহি চাওলার সাথে জুটি গড়েন, যার সাথে জুটিবদ্ধ হয়ে তিনি পরবর্তী কালে আরও অনেকগুলো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।
শাহরুখ খান ৩০টি ফিল্মফেয়ার পুরস্কারের মনোনয়ন থেকে ১৪টি পুরস্কার এবং একটি বিশেষ পুরস্কার অর্জন করেন।দিলীপ কুমারের সাথে যৌথভাবে তিনি শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে সর্বাধিক আটটি পুরস্কার বিজয়ের রেকর্ডধারী।খান বাজীগর (১৯৯৩), দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে (১৯৯৫), দিল তো পাগল হ্যায় (১৯৯৭), কুছ কুছ হোতা হ্যায় (১৯৯৮), দেবদাস (২০০২), স্বদেশ (২০০৪), চাক দে! ইন্ডিয়া (২০০৭), ও মাই নেম ইজ খান (২০১০) চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেন।
তিনি কোন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন না করলেও ২০০৫ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মাননায় ভূষিত করে। ফ্রান্স সরকার তাকে ২০০৭ সালে অর্দ্র দে আর্ত এ দে লেত্র,ও ২০১৪ সালে ফরাসি লেজিওঁ দনরের পঞ্চম পদ শ্যভালিয়ে খেতাব প্রদান করে।খান পাঁচটি সম্মানসূচক ডক্টরেট গ্রহণ করেন; প্রথমটি ২০০৯ সালে বেডফোর্ডশায়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, দ্বিতীয়টি ২০১৫ সালে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে,তৃতীয়টি ২০১৬ সালে মৌলানা আজাদ জাতীয় উর্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে,শেষ দুটি ২০১৯ সালে ইউনিভার্সিটি অব ল ও লা ট্রোব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।
আলিবাগের আলিশান বাড়িতে শাহরুখের জন্মদিনটা সেলিব্রেট করবার প্ল্যান করে রেখেছিলেন তারকা দম্পতি। আব্রামেরও তেমনই ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সব প্ল্যানিং নাকি ভেস্তে গিয়েছে গত একমাসের ঘটনার ঘনঘটায়। আলিবাগ যেতে হলে কোলাবা থেকে জলপথে রওনা দিতে হবে শাহরুখ-গৌরীদের। পাপারাতজিদের ভিড় মন্নতের বাইরে সারাক্ষণ লেগে রয়েছে। এই অবস্থায় কোনওভাবেই আরিয়ানকে নিয়ে আলিবাগে যাওয়ার রিস্ক নিতে রাজি নন শাহরুখ। তাই মন্নতেই ঘরোয়াভাবে জন্মদিনটা কাটাবেন তিনি।