“ ওঁ গঙ্গা গঙ্গেতি যোগ ব্রুয়াদ্ যোজনানং শতৈরপি। মুচ্যতে সর্বপাপেভ্য বিষ্ণু লোকং সগচ্ছতি।।
পাপহং পাপকর্মাহং পাপাত্মা পাপ সম্ভবতঃ।
ত্রাহিমাং পুন্ডরিকাক্ষ সর্বপাপ হরহরিঃ “
বাঙালির সমস্ত পূজোতে গঙ্গা জল,গঙ্গা মাটি অবশ্য প্রয়োজনীয়। আর কিছু বিশেষ বিশেষ তিথিতে যদি গঙ্গা স্নান করা যায়,তাহলে অনেক পুণ্য সঞ্চয় করা যায়। গঙ্গা মন্ত্র উচ্চারন করে স্নান করলে সমস্ত রকম পাপ থেকে মুক্তি লাভ হয়। সনাতন ধর্মালম্বীরা “গঙ্গা গঙ্গা” উচ্চারন করে স্নান করলে তাদের সমস্ত পাপ ধুয়ে ফেলতে পারেন। তার স্থান হয় বৈকুন্ঠে। আমাদের প্রাচীন পুরাণে গঙ্গাস্নানের মাহাত্ম্যের কথা অনেক লেখা আছে। এমনকি গঙ্গার মাহাত্ম্যর কথা ভগবান শিবও বলেছিলেন পার্বতীকে। গঙ্গা হলেন পুণ্যদায়িনী। এটা আমরা সকলেই জানি। তাই আমরা সকলেই গঙ্গা স্নান করে থাকি পুণ্য লাভের আশায়।বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত সবচেয়ে বড় তীর্থস্থান পণাতীর্থ এমনি এক স্থান,যেখানে কায়মনোবাক্যে একবার স্নান করলেই অতীতের সব পাপ স্খলন হয়;অর্জন করা যায় অশেষ পুণ্য ও ঈশ্বরের আশীর্বাদ। অন্য তীর্থের মতো সেখানে বারবার স্নান করার প্রয়োজন নেই। প্রতি বছর চৈত্র মাসে মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে (গৌর পূর্ণিমার পরের ত্রয়োদশী) হাজার হাজার হিন্দু নর-নারী ও শিশু স্রোতস্বিনী যাদুকাটা নদীর স্বচ্ছ নীল পানিতে পণাতীর্থ বা বারুণী স্নান করে কলুষমুক্ত হন এবং ঈশ্বরের কৃপা লাভ করেন। তাদের বিশ্বাস পণাতীর্থ স্নানের মাধ্যমে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। স্কন্দ পুরাণ অনুসারে চৈত্রমাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে শতভিষা নক্ষত্র যোগ হলে সেই তিথি বারুণী নামে পরিচিত। এই তিথিতে স্নান করলে বহুশত সূর্যগ্রহনের জন্য গঙ্গাস্নানের যে ফল সেই ফল লাভ করা যায়। হিমালয় কন্যা গঙ্গার অপর নাম হল বারুণী। বারুণী স্নান বলতে এখানে গঙ্গা স্নানেরই প্রতিরুপ।বাঙলা সনের প্রতি চৈত্র মাসের শতভিষা নক্ষত্রযুক্ত মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে এই স্নান অনুষ্ঠিত হয়।
করোনার কারণে দুই বছর বন্ধ থাকার পর সিলেটের সুনামগঞ্জ সীমান্তের তাহিরপুরের যাদুকাটা নদীতে এবারও লাখো পুণ্যার্থীর সমাগম ঘটেছে। বুধবার (৩০ মার্চ) সকাল ৬ টা ৬ মিনিট থেকে ১১টা ২৩ মিনিট পর্যন্ত ছিল স্নানের তিথি। চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথিতে যাদুকাটা নদীতে স্নান করলে সব পাপ মোচন হয় বলে প্রচলিত আছে। পুণ্য লাভের আশায় প্রতিবছরই দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এই সময়ে লাখো মানুষ আসেন যাদুকাটা বা পুণ্যতীর্থে স্নান সারতে। এ নদীতে স্নান করাকে অনেকে গঙ্গাস্নানের সমতুল্য মনে করেন।
১৪৩৪ খ্রিস্টাব্দের মাঘ মাসে শ্রীশ্রীঅদ্বৈত আচার্য তাহিরপুর উপজেলার লাউড় পরগণার অন্তর্গত নবগ্রামে আবির্ভূত হন। তবে নবগ্রাম যাদুকাটার নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে বহু আগেই। বর্তমানে অদ্বৈত আচার্য প্রভুর মন্দির গড়ে উঠেছে নবগ্রাম সংলগ্ন রাজারগাঁওয়ে। ‘অদ্বৈত প্রকাশ’ গ্রন্থে উল্লেখ আছে,একদিন রাত্রিতে অদ্বৈত জননী নাভাদেবী স্বপ্নে দেখেন যে,তিনি নানা তীর্থ জলে স্নান করছেন। প্রভাতে তিনি স্বপ্নের কথা স্মরণ করে ও তীর্থ গমনের নানান অসুবিধার বিষয় চিন্তা করে বিমর্ষ হয়ে পড়েন। এমন সময়ে পুত্র অদ্বৈতাচার্য সেখানে উপস্থিত হয়ে মাতার বিমর্ষতার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তাঁর মাতা তাঁকে স্বপ্ন দর্শনের কথা অবহিত করেন এবং তীর্থযাত্রায় অপারগতার কথা প্রকাশ করেন। অদ্বৈাতাচার্য্য মাকে বিষন্ন দেখে পণ করলেন যে,এই স্থানেই সকল তীর্থের আবির্ভাব করাবেন। অদ্বৈতাচার্য মন:শক্তির অসীম প্রভাব ও যোগবলের অসাধারণ শক্তিতে তীর্থ সমূহকে আকর্ষণ করে লাউড়ের এক শৈলের উপর আনয়ন করেন। ঐ শৈল খণ্ডের একটি ঝরণাতীর্থবারি পরিপূরিত হয়ে ঝরঝর করে পড়লে লাগলো। অদ্বৈত জননী তাতে স্নান করে পরিতৃপ্তা হলেন। এইভাবে লাউড়ে এই তীর্থের উৎপত্তি হয়। অদ্বৈতের ন্যায় তীর্থ সমূহও পণ করেছিলো যে,প্রতি বারুণীতেই এই স্থানে তাঁদের আবির্ভাব হবে। এই পণ শব্দ থেকেই নাম হয়েছে পণাতীর্থ।
১৪৩৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর স্ত্রী নাভা দেবীর গর্ভে এক সন্তান লাভ করেন। কমলের মত সুন্দর বলে তার নাম রাখেন কমলাক্ষ। কমলাক্ষের মাতা নাভাদেবী স্বপ্নে দেখতে পান তার ক্রোড়স্থ শিশু শঙ্খচক্র গদাপদ্বধারী মহাবিষ্ণু। তার অঙ্গজ্যোতিতে চারদিক আলোকিত,মুখে দিব্য আভা। হতবিহবল নাভা দেবী সেই স্বর্গীয় মূর্তির সম্মুখে প্রণত হয়ে শ্রী চরণোদন প্রার্থনা করেন। কিন্তু মাতা কর্তৃক সন্তানের পাদোদক প্রার্থনা করা অনুচিত। তাই স্বপ্ন ভেঙে গেলে নাভা দেবী মহাচিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কমলাক্ষের অনুরোধে স্বপ্নের সকল বৃত্তান্ত তাঁকে খুলে বলেন। সবশেষে বললেন সপ্ততীর্থ বারি অবগাহনের ভাগ্য কি আমার হবে? মায়ের অভিলাষ পূরণে কমলাক্ষ হাত মুষ্টি করে বললেন,‘সপ্ততীর্থ হানি হেথায় করিব স্থাপন’। আজ রাতে সকল তীর্থের এখানে আগমন ঘটবে এবং আগামী প্রাতে মাতা সে তীর্থ বারিতে অবগাহন করবেন। নিকটস্থ শৈল শিকড়ে কমলাক্ষ অবস্থান করে প্রভাতে ঘণ্টা ধ্বনি করলেন। সাথে সাথে সকল তীর্থবারি অঝোর ধারায় বয়ে যেতে শুরু করল।
কমলাক্ষের মাতা নাভা দেবীর যেন বিশ্বাস হতে চায়না-মনে প্রশ্ন জাগে এ সত্যই কি সপ্ততীর্থ? কমলাক্ষ তার মায়ের সঙ্গে সপ্ততীর্থ বারিকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। এই হল শ্যামার সামৃত যমুনা,পাপনাশিনী গঙ্গা এবং রক্তপীথ আদি তীর্থ বারি। আনন্দ উৎফুল্ল মনে জননী তীর্থগণকে প্রণাম করে সপ্ততীর্থ বারিতে অবগাহন করলেন। সেই থেকে এই তীর্থের নাম হল পণাতীর্থ/পুণ্যতীর্থ। তীর্থগণ পণ করে গিয়েছিলেন পৃথিবী যতদিন থাকবে ততদিন প্রতি বছর মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে তীর্থগণের আগমন ঘটবে এখানে।
এরপর ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দের দিকে পণাতীর্থের সূচনা করেন শ্রীমান অদ্বৈত আচার্য্য প্রভু। মানুষ তাঁকে গৌরআনা ঠাকুর বলে জানেন। তাঁর জন্মস্থান তাহিরপুর উপজেলার বাদাঘাট ইউনিয়নের নবগ্রামে। নদী ভাঙনে নবগ্রাম আজ বিলীন। সে সময় নব গ্রামের অবস্থান ছিল লাউড় রাজ্যের লাউড়েরগড় এলাকায়। বর্তমানে মন্দির গড়ে উঠেছে যাদুকাটা নদীর তীরবর্তী লাউড়েরগড়ের পার্শ্ববর্তী রাজারগাঁও গ্রামে। কিছুকাল পর এই সত্য প্রতিফলিত হয় যাদুকাটা নদীর তীরে। এ পুণ্য তিথিতে বেড়ে যায় জলের ধারা। আর এই জলধরায় স্নান করলে পাপ মুক্ত হওয়া যাবে এই ধাণা থেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এই সময়ে যাদুকাটা নদীতে স্নান করতে আসেন। স্নানকে কেন্দ্র করে ধর্মীয় সম্প্রীতির মিলন মেলা বারুনী মেলা প্রাচীন কাল থেকে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এখানে কেউ এসেছেন অস্তি নিয়ে,কেউ পুণ্যের আশায়,আবার কেউ আসেন মানত নিয়ে।
তাহিরপুর উপজেলার চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু জানান,’ মাহা-বারুণী মেলা গঙ্গাস্নান কেন্দ্র যাদুকটার তীরে লাখো পুন্যার্থী ও ভক্তবৃন্দের সমাগম হয়েছে। মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশী তিথি এ সময়ের মধ্যে পুন্যস্নান করছেন দেশে বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পুন্যার্থীরা। সার্বিক নিরাপত্তা ও সহযোগিতায় নিযুক্ত ছিলেন হাজার সেচ্ছাসেবী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা ‘।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রায়হান কবির বলেন, ‘ এ উৎসব ঘিরে কয়েক লাখ মানুষের সমাগম ঘটেছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। মহা-বারুনী গঙ্গাস্নান এলাকা মনিটরিং ও ভক্তদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দিতে পুলিশ,র্যাব ও বিজিবি সদস্যরা কঠোর অবস্থানে আছেন ‘।