সত্যজিৎ দাস:
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালে,যখন ঐ রাজনৈতিক সংগঠন নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ ছাত্র সমাজ,যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ ছাত্র লীগে পরিণত হয়। তবে,এই সময়ে রাজনীতি এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে বেশ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় । প্রাথমিকভাবে এই সংগঠনগুলি ছিলো ছাত্রদের মনোযোগ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে,যাতে তারা সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানে সহায়তা করতে পারেন।
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির প্রথম প্রতিষ্ঠিত পায় বাংলাদেশ ছাত্র সমাজের মাধ্যমে,যা ১৯৫২ সালে শুরু হয়। এই সংগঠনের প্রধান প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তোফায়েল আহমেদ। পরবর্তীতে এই সংগঠন পরিণত হয় বাংলাদেশ ছাত্র লীগে,যা তখন পাকিস্তানের ছাত্র লীগের অনুলিপিসমূহের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গঠন হয়েছিলো,সেসময় ছাত্রদের রাজনীতি আর্থ সামাজিক কাজে জড়িত হতো। তৎকালীন সময়ে প্রাথমিকভাবে ছাত্র রাজনীতির শুরু হয়েছিলো;-ঢাকা মেডিকেল কলেজ,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,ইউনিভার্সিটি অফ ঢাকা,বুয়েট,চিটাগং বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানে।
তবে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্র রাজনীতির শুরু হয়েছিলো শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। মুক্তিযুদ্ধের পরে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর,শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রদের আওতায় সরকার গঠন করেন। তাঁর নেতৃত্বে এই ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহণের পর ছাত্র লীগের প্রতিষ্ঠা হয়। এরপর ছাত্র লীগ বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির মৌলিক বহুভাবে পরিচালনা করে।
বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে প্রধানত ছিল দেশের স্বাধীনতা,ন্যায্যতা, সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান, ছাত্রদের সম্পৃক্ত বিষয়ে মন্তব্যযোগ্যতা ও প্রতিষ্ঠানের উন্নতি পর্যন্ত নির্বাহ করা। ছাত্র রাজনীতির অন্যান্য উদ্দেশ্যের মধ্যে ছিল ছাত্রদের শিক্ষার মান ও মানুষের সাথে তাদের সম্পর্ক উন্নত করা,সামাজিক বিষয়ে সচেতনতা ও জ্ঞান বাড়ানো, রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিক নৈতিকতা ও নৈতিক মূলধারা রক্ষা করা ইত্যাদি। কিন্তু বর্তমানে বহুলাংশেই ছাত্র রাজনীতির নীতি নৈতিকতা বিলুপ্ত।
তবে বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য একটি ইতিবাচক ক্ষেত্র হতে পারতো,কারণ এটি ছাত্রদের মতামত ও দাবির নির্ধারণে সহায়ক। ছাত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে ছাত্রদের মধ্যে মন্তব্য ও ভোটের অধিকার প্রদান করে এবং তাদের প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন বিষয়ে মন্তব্য করার সুযোগ প্রদান করে। তবে,এটি যে মাত্রা ইতিবাচক হবে তা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতি প্রতিষ্ঠানের সুযোগ এবং বাস্তব পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে নানা রাজনৈতিক দলের সহায়তায় ছাত্র রাজনীতিকে সময় সময়ে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে আসছে। এটি বিশেষতঃ নির্বাচনী সময়ে প্রকাশ্যে দেখা যায়। সরকারী সহায়তায় ছাত্রদের রাজনৈতিক দলগুলোর কার্যক্রমে সমর্থন ও তাদের প্রচারে সহায়তা প্রদান করে। এছাড়াও,সরকারের প্রতিষ্ঠান পরিচালক পদাধিকারীদের মধ্যে থাকা সম্পর্কের মাধ্যমে ছাত্র দলের কাজের সহায়তা ও সুযোগ প্রদান করা হয়ে থাকে। এতে করে,ছাত্র রাজনীতি সরকারের নীতিমালা ও অবস্থানের সাথে সংগতি প্রদর্শন করে।
ছাত্র রাজনীতির ক্ষতিকর দিকঃ-
(১) পড়াশোনার বিঘ্নতা: ছাত্র রাজনীতি করায় ব্যস্ততার ফলে পড়াশোনা এবং অন্যান্য শিক্ষাগত কার্যকলাপের জন্য সময়ের অভাবে পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটে।
(২) সামাজিক ও ব্যক্তিগত সমস্যা: ছাত্র রাজনীতি করায় সামাজিক এবং ব্যক্তিগত সমস্যার সমাধানের সময় কম হতে থাকে,ফলে তাদের সাম্প্রতিক জীবনে বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।
(৩) দাবি ও বিবাদ: ছাত্র রাজনীতিতে সমাজের অপরাধিক দৃষ্টিকোণ ঝাপসা হওয়ার কারণে যা পড়াশোনা ও প্রতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষতিকর হচ্ছে।
(৪) বিরোধ এবং হুমকি: অনেক সময়ে ছাত্র রাজনীতিতে সংগঠিত থাকার ফলে,তাদের বিরোধী দলের সদস্যদের হামলা এবং হুমকির শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকে,যা পড়াশোনা সহ ছাত্রদের পারিবারিক জীবনেও প্রভাব ফেলে।
(৫) শিক্ষার মান-পতন: চলমান সময়ে ছাত্র রাজনীতির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিমাণে অনুদান দাবি এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধা সরকার বা প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত করতে হলে,তাদের পড়াশোনার মান পতনের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
(৬) সময়ের অভাব: ছাত্র রাজনীতির সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ নেওয়া কারণে,ছাত্রদের পড়াশোনার জন্য যথেষ্ট সময় না থাকার কারণে তাদের পড়াশোনা ক্ষতি হয়।
(৭) মনোযোগের অভাব: ছাত্র রাজনীতি করার কারণে ছাত্রদের মনোযোগ পড়াশোনার যে ভাবাবেগ থাকা উচিত,তা রাজনীতির কারণে দৈনন্দিন পাঠ্যসূচি সম্পন্ন করতেও ব্যাঘাত ঘটায়।
প্রসঙ্গত,আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছাত্র রাজনীতির খারাপ কর্মকাণ্ডের সংক্রান্তে নিম্নলিখিত কিছু ঘটনা ঘটেছে:
ছাত্রদের আক্রমণ: আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে কুলিগুলি,ছাত্র সংস্থা নেতাদের বিরোধী দলের সদস্যদের আক্রমণ হয়েছিল।
ছাত্র নেতাদের আহত-নিহত: কিছু ঘটনায় আওয়ামী লীগ ছাত্র সংস্থা নেতাদের গুরুতর আহত থেকে শুরু করে নিহতের ঘটনাও ঘটেছে।
ছাত্র নেতাদের গ্রেপ্তার: কিছু ঘটনায় ছাত্র নেতাদের গ্রেপ্তার করে,হেলিকাপ্টার থেকে ফেলা হয়েছিল।
ছাত্রদের বিরোধী হিংসাত্মক আচরণ: আওয়ামী লীগ সরকারের সমর্থক ছাত্র সংস্থার ছাত্র নেতারা বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলোর সাথে প্রায়সময়ই হিংসাত্মক আচরণ করে চলেছেন। যা সামাজিক ভাবভঙ্গিও নষ্ট করে।
এই ধরনের ঘটনাগুলি সাধারণত ছাত্র রাজনীতির ভয়াবহতা ও সামাজিক ন্যায্যতা নিয়ে সম্পর্কিত এবং যা ছাত্রদের শিক্ষার পথে বাধার সৃষ্টি করে।
২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ছাত্র রাজনীতির প্রভাব অনেকটাই প্রভাবশালী ছিল। ছাত্র রাজনীতি বাংলাদেশের রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিগন্ত হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। কিছু প্রধান প্রভাবগুলি হলো:
(১) বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন: ছাত্র সংগঠনের প্রভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল,যা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিয়ম কানুন এর ওপর প্রভাব ফেলেছিল।
(২) সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন: ছাত্র রাজনীতির পরিষেবা সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পরিধি বাড়ানোর জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল।
(৩) প্রতিষ্ঠানিক নীতি নির্ধারণ: ছাত্র সংগঠনের প্রভাবে প্রতিষ্ঠানের নীতি নির্ধারণে ব্যবহৃত হয়েছিল।
(৪) সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রচার: ছাত্র রাজনীতি সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রচারিত হয়েছিল এবং জনগণের মধ্যে জাগরুকতা থেকে ভয় ও আতঙ্কিততা বৃদ্ধি পেয়েছিল।
(৫) দলের ভূমিকা প্রভাবশালী হওয়া: ছাত্র রাজনীতি ছাত্র সংগঠনের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল,যা রাজনীতিতে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করেছিল।
এই সময়ে ছাত্র রাজনীতির প্রভাব এতোটাই বেশি প্রমাণিত হয়েছিল যে,যার মাধ্যমে রাজনীতি ও সামাজিক নীতিগত পরিবর্তন বাণিজ্যিক,সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দিকে যতটুকু বৃদ্ধি পেয়েছিল,ততটুকু ক্ষতিও হয়েছিলো।
তাই,ছাত্ররা যদি রাজনীতির সমস্ত প্রভাবকে সাবধানতার সাথে নিয়ে পরিবেশন করে,তাহলে এটি তাদের পড়াশোনার জন্য কোনো ক্ষতি হবেনা।
এশিয়া মহাদেশের তুলনায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক মাঠ অনেকটা জটিল। এ দেশের মাটি এখন পুরোটাই একটি রাজনৈতিক ক্ষেত্র। অনেক বছর ধরে যে মাটিকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল নানামুখি জল্পনা-কল্পনা। তা পর্যালোচনা করলেই বুঝা যায় বাংলাদেশ প্রকৃত ভাবেই একটি রাজনৈতিক দেশ।
ডিজিটাল যুগে বাংলাদেশ পদার্পণ করলেও,এখনও বাংলার রাজনীতিতে ক্লিন মাইন্ডের সুশিক্ষিত যুবক,তরুণ সহ যোগ্য ব্যক্তি,যারা রাজনীতির সুফল ও কুফল সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন ও নিজ দেশের জনগণের কথা ভাবেন। যে ও যারা এখনও সোনার বাংলাদেশের সার্বিক মঙ্গলের জন্য রাজনৈতিক মনোভাব পোষণ করেন তাদেরকে সুস্থ ও পরিষ্কার মন-মানসিকতার রাজনীতিবিদ হিসেবে গণ্য করা হয়।
কারণ তারা দেশের যেকোনো সংকট মোকাবিলায় সবার আগে সামনের কাতারে বুক উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকেন ও দেশ-দশের মঙ্গলের জন্য তাদের রাজনৈতিক প্রভাব পরিচালনা করেন। দেশে রাজনৈতিক সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধিকল্পে এবং দেশকে নতুন কিছু দেওয়ার জন্য নতুন রাজনীতিবিদের পদার্পণ অতি জরুরি। তারাই পারেন এই বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি থেকে দূর্নীতি,অরাজকতা,লুটপাট, মাস্তানি,অবৈধ প্রভাব বিস্তার সহ নানা অসংগতি দূর করতে।
সত্যজিৎ দাস (ব্লগার ও সংবাদ মাধ্যম কর্মী)
মৌলভীবাজার,সিলেট।
মোবাইল: +8801783885646
সিলেট নিউজ২৪/এসডি.