রেখা পাঠক (কানাডা প্রবাসী):
শ্রীমদ্ভগবদ গীতায় ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সূর্যের দক্ষিণায়ন ও উত্তরায়ণ সম্পর্কে বলেছেন;-এই দিনে মা যশোদা শ্রীকৃষ্ণকে পুত্র রূপে পাওয়ার জন্য তপস্যা শুরু করেছিলেন। এই দিনে দেবাসুরের যুদ্ধে অসুররা দেবতাদের কাছে পরাজিত হয় এবং এই দিনে সূর্য দেবতা তাঁর পুত্র শনি দেবর সাথে মিলিত হোন,অর্থাৎ বৈদিক জ্যোতিষ শাস্ত্র মতে মকররাশির অধিপতি হলেন গ্রহরাজ শনি। মকর সংক্রান্তিতে সূর্য দেবতা মকররাশিতে প্রবেশ করেন বলে,জ্যোতিষ শাস্র মতে সূর্য একমাস পুত্র শনির ঘরে অবস্থান করেন।
এই বিশেষ পুণ্যময়দিনে দধি দিয়ে শ্রীবিষ্ণুকে স্নান করিয়ে বিশেষ অর্চনা করা হয়,বলে এ সংক্রান্তিকে দধি সংক্রান্তি ও বলে।সনাতনধর্মের ধর্মীয় আচার-আচরণ ও মাঙ্গিক ক্রিয়াকর্মে দধি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ তিল। সনাতনধর্মের পূজা-অর্চনার একটি অন্যতম প্রধান উপকরণ। শ্রী বিষ্ণু’কে সুগন্ধি চন্দনের সাথে কালো তিল মিশিয়ে তুলসী নিবেদন করতে হয়,কারণ হলো;-ঈশ্বর /ভগবানের শ্রীচরণ হতে আমরা যেন তিল পরিমাণ বিচ্যুত না হই। তিল পরিমাণ সময়ের জন্য ও যেন আমরা ভগবানকে ভুলে না থাকি।
উত্তরায়ণ সংক্রান্তিতে তিল খাওয়ার নিয়ম থাকার আরেকটি কারণ হলো,তিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভেষজ। এরমধ্যে প্রচুর স্নেহ জাতীয় পদার্থ রয়েছে,ফলে দেহের চর্মের শ্রীবৃদ্ধির জন্য এই সময় আনুষ্ঠানিক ভাবে তিল জাতীয় সুন্দর,সুস্বাদু দ্রব্য ভোজন করার রীতি প্রচলিত আছে বলে একে তিলোসংক্রান্তিও বলা হয়।
এই পুণ্যময় দিনে কলিযুগের অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহাপ্রভু,গৃহ ত্যাগ করে কাটোয়া গিয়েছিলেন কেশবভারতীর আশ্রমে সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য। যদিও অনেকে বলেন যে,এই মকরসংক্রান্তি/উত্তরায়ণ সংক্রান্তির দিনে নিমাই বিশ্বম্ভর মিশ্র সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। কিন্তু চৈতন্যচরিতামৃতে আছে-“চব্বিশ বৎসর শেষ যেই মাঘ মাস। তার শুক্লপক্ষে প্রভু করিলা সন্ন্যাস। “এতে কৃষ্ণ দাস কবিরাজ গোস্বামী কী বুঝালেন? নিমাই কী উত্তরায়ণ সংক্রান্তির দিনই সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করেছিলে,না এই দিন গৃহত্যাগ করেছিলেন সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণমকরার জন্য?
কেশব ভারতী তাঁকে সন্ন্যাস মন্ত্রে দীক্ষাদান করেন উত্তরায়ণ সংক্রান্তির দিন,না পহেলা মাঘ? ফাল্গুনী পূর্ণিমায় নিমাইর জন্ম। সেই হিসেবে যে মাঘ মাসের,যে তারিখে তাঁর চব্বিশ বছর পূর্ণ হয়,সেই মাঘ মাসের শুক্লপক্ষে তিনি সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণ করে রাধাভাবে আকুল হয়ে শ্রীধাম বৃন্দাবনের পথে গমন করেন। হিসেব নিকাশ করলে নিমাই বিশ্বম্ভর মিশ্রের সন্ন্যাসাশ্রম গ্রহণ করার দিন ক্ষণ ঠিকই পাওয়া যাবে। তবে,আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠার পরিবেশে মকরসংক্রান্তি/সূর্যের উত্তরায়ণের দিন সকাল বেলা যে নগর কীর্তন বের হয়,সে কীর্তনে কীর্তনীয়ারা ষোলনাম বত্রিশ অক্ষর ছাড়া ও অনুভুতিতে এক চরম অব্যক্ত বৈরাগ্যের মূর্ছনায় আকুল হয়ে এই গানটি গেয়ে নগর পরিক্রমা করেন-“গৌর চলছে ব্রজ নগরে। জয় রাধা শ্রী রাধার নাম লয়ে। আমায় বলে দেরে নগর বাসী মধুর বৃন্দাবন আর কত দূরে ”
মকর সংক্রান্তিতে উত্তরায়ণের প্রথম সকালে ফসল শূন দিগন্ত বিস্তৃত কুয়াশা ভেজা পৌষের মাঠের নীরবতার মধ্য দিয়ে উত্তরায়ণের প্রথম অরুণ রবির আলো গায়ে মেখে নগর কীর্তনীয়াদের কণ্ঠে রাধাভাবে কৃষ্ণপ্রেমে আকুল নবীন সন্ন্যাসী শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য মহা প্রভুর ব্রজ গমনের এই আকুল আর্তি মকর সংক্রান্তির সমস্ত সকাল বেলাটাকে যেন কোন সুদূর হতে আসা না বলা এক বৈরাগ্যের আবেগময় ভাবালুতায় ভরে দেয়। মনে মনে মন সংসারের বন্ধন ছেড়ে চলে যায় নবীন সন্ন্যাসী শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্যদেবের চরণ চিহ্ন অনুসরণ করে সেই মধুর বৃন্দাবনে।
মকরসংক্রান্তির উত্তরায়ণের প্রথম দিনটির এক সুনসান নীরবতা যেন বছরের অন্যান্য দিনের চেয়ে এক আলেদা অনুভূতির আবেদন জাগায় মনের ভেতরে। মকরসংক্রান্তি কী কেবলই নতুন ধানের আর নতুন পাটালিগুড়,খেজুরের গুড়েরে সমাহারে তৈরি পিঠা পুলি সহ নানান জাত পিঠা পায়েশ, সন্দেশ আর তিলের নাড়ু খাওয়া আর খাওয়ানোর দিন? না-কেবল এই সব নান্দনিক পিঠা পায়েস আয়োজনের মধ্যে দিনটি সীমাবদ্ধ নয়। এই সবকে ছাপিয়ে ঝাঁপিয়ে সনাতনী হিন্দুদের প্রধান কর্তব্য কাজ হলো,ব্রম্মমুহুর্তে ঘুম হতে ওঠে পবিত্র জলে স্নান করে (নতুন জামা কাপড় পরে,অবশ্য যাদের সামর্থ্য থাকে) গৃহ দেবতাকে ভক্তি ভরে প্রণাম করে,স্বর্গবাসী পূর্ব পুরুষদের প্রণাম করে,সূর্য প্রণাম করে,গৃহ দেবতাকে নতুন ধানের পিঠা পায়েস নিবেদন করে,তবেই নিজেদের পিঠা রাজ্যে প্রবেশ করা উচিত।
চলবে……………………
সিলেট নিউজ/সাংস্কৃতিক/মুক্ত কলাম/এসডি.