সত্যজিৎ দাস:
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিয়েছিলেন। ১০ লক্ষাধিক লোকের সামনে পাকিস্তানি দস্যুদের কামান-বন্দুক-মেশিনগানের হুমকির মুখে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
সেই ভাষণ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল। এর প্রায় দুই সপ্তাহ পরেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ এ ছিল একজন দক্ষ কুশলীর সুনিপুণ বক্তব্য উপস্থাপনা। বিশেষ করে ভাষণের শেষ পর্যায়ে তিনি স্বাধীনতার কথা এমনভাবে উচ্চারণ করলেন যাতে ঘোষণার কিছু বাকিও থাকল না, অপরদিক তার বিরুদ্ধে একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণার অভিযোগ উত্থাপন করাও শাসকগোষ্ঠীর জন্য আদৌ সহজ ছিল না।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অত্যুজ্জ্বল দিকনির্দেশনা।এই ভাষণের প্রতিটি আহ্বান অধিকারবঞ্চিত দেশবাসীর হৃদয়ে গভীর রেখাপাত করে। তাই আমাদের মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক ও বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বাণীর সেই দিনটিতে আমরা আবারও নতুন করে শপথ নিই- ‘এবারের সংগ্রাম বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার সংগ্রাম।’
বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ মনে করেন- প্রায় ১৮ মিনিটের এই ভাষণে সবদিকই উঠে এসেছিল। ‘এই একটি ভাষণের মাধ্যমে তিনি একটি জাতিকে সশস্ত্র বাঙালি জাতিতে রূপান্তর করেছিলেন। স্বাধীনতার বীজ তিনি বপন করেছিলেন।’ ‘এবারের সংগ্রাম,আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যার যা কিছু আছে,তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকো।’
এই বক্তব্যের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু একটা গেরিলা মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশনা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ ছিল বস্তুত বাংলাদেশের স্বাধীনতারই ঘোষণা। একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসেবে দেশের অভ্যন্তরে কিংবা বহির্বিশ্বে যাতে চিহ্নিত না হন,এ ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু সদা সতর্ক ছিলেন।
স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার অভয়মন্ত্রে উজ্জীবিত করে যে ভাষণ দিয়েছিলেন তা এখন বিশ্ব-ঐতিহ্যের স্মারক। ৭ই মার্চের ভাষণটি ছিল নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। এই ভাষণ ছিল অলিখিত। একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত লাখ লাখ জনতার সামনে তিনি ভাষণটি দিয়েছিলেন।
কিন্তু উপস্থিত সকলের কাছে মনে হচ্ছিল যেন তিনি একটি লিখিত কবিতা পাঠ করেছেন। এই ভাষণের কারণেই বিশ্ববিখ্যাত গণমাধ্যম তাঁকে ‘রাজনীতির কবি’ হিসেবে অভিহিত করেছিল। ভাষণটি জাতিসংঘের ইউনেস্কোর ‘মেমোরি অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল’ তালিকায় স্থান পেয়েছে। যে ভাষণ ছিল বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের এক গৌরবগাথা,সে ভাষণ এখন বিশ্বের এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃত।
১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে (০৭ মার্চ) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন,আজও এর তাৎপর্য জাতীয় জীবনে গভীরভাবে অনুভূত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পর দুই যুগব্যাপী সংগ্রাম-সাধনার মধ্য দিয়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা মুক্তির যে মোহনায় উপনীত হয়েছিল তাকে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে ৭ই মার্চের ভাষণটি ছিল অবিস্মরণীয়।
পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু এই ভাষণের মাধ্যমে মুক্তিপাগল বাঙালির মনে প্রত্যয়ের যে বীজ বপন করেছিলেন বিশ্বের ইতিহাসেই এটি এক বিরল ঘটনা। এমন দৃষ্টান্ত অন্য কোথাও নেই। এটিই বাঙালির গর্ব ও অহংকারের।
বাঙালির বীরত্বপূর্ণ দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটনে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের বিশেষ গুরুত্ব অপরিসীম। ৭ই মার্চের ভাষণ বঙ্গবন্ধুর অমর রচনা, বাঙালির এক মহাকাব্য। এ মহাকাব্য বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রামের ধারা ও স্বাধীনতার লালিত স্বপ্ন থেকে উৎসারিত। একমাত্র বঙ্গবন্ধুর পক্ষেই এমন মহাকাব্য রচনা সম্ভব ছিল,কেননা তিনিই হলেন এ ধারার সার্থক প্রতিনিধি।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ এসেছিল এক ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে। আন্দোলনের একপর্যায়ে মার্চের প্রথম দিন থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাজপথ। এরই মধ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়ানো হয়েছে। পাঠ করা হয় স্বাধীনতার ইশতেহার এবং নির্বাচন করা হয় জাতীয়সংগীত।
৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত ভাষণটি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম সে সময় যেসব মন্তব্য করেছে তা খুবই গুরুত্বের দাবি রাখে। কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ত্রো বলেছেন- ‘৭ই মার্চের শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ শুধু ভাষণ নয়,এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল।’ এছাড়া তিনি বলেছেন- ‘আমি হিমালয় দেখিনি,তবে আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমতুল্য। আর এভাবেই আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা লাভ করেছি।’
ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ সে সময় বলেছিলেন- ‘পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে,ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চির জাগরুক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্যই নয়,সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের জন্য তা অনুপ্রেরণার উৎস।’
সিলেট নিউজ২৪/এসডি.